তরল – ২ (শারদদা সিরিজের গল্প)


পরদিন ইন্সপেক্টার জেমস আমাদের পূর্ব পরিকল্পনা মত অন্যদের থেকে তথ্য সংগ্রহের বাহানায় জেরা করতে আসলো। রেস্টুরেন্টের কর্মচারি রয়েছে তিনজন। একটা মেয়ে, জেনিফার এবং দুটো ছেলে, মার্ক এবং ড্যানিয়েল। জেনিফার জার্মানীর মেয়ে। খুব চুপচাপ প্রকৃতির। কাজে কখনও অবহেলা করতে দেখিনি। যখন যা করতে বলতাম সাথে সাথেই করতো এবং বেশ গুছিয়েই করতো। মার্ক ছিল ঠিক উল্টা। সে স্থানীয় স্কটিশ। সব সময় উঁচু স্বরে কথা বলতো। রেস্টুরেন্টে উল্টাপাল্টা প্রকৃতির কোন ছেলে আসলে মার্কের সাথে লেগে যেত সহজেই। তবে কাজের ক্ষেত্রে সেও বেশ চটপটে এবং কখনও ফাঁকি দেয়ার চেষ্টা করতো না। ড্যানিয়েল একটু অন্য ধরণের ছেলে ছিল। কথা প্রায় বলতই না। কারো সাথে মিশতোও না। আমাদের স্বভাব ছিল আমরা কাজের ফাঁকে মাঝে মাঝে আলোচনার আসর বসাতাম। সেখানে সমাজ, রাজনীতি, ইতিহাস, দর্শন, ধর্ম – সব কিছু নিয়েই আলোচনা হতো। ড্যানিয়েল সাধারনত সে সব আলোচনায় আসতো না। যদিওবা কখনও এসে বসতো, তবে সেটা হয়তো আলোচনা শোনার আগ্রহে না বরং টিভিতে কি সংবাদ হচ্ছে সেটা দেখার জন্য।

জেমস একটা রুমে আলাদা আলাদা ভাবে সবার সাথে কথা বলছিল। সবাইকে প্রশ্ন করা শেষ হলে সে আমাকে ডাকলো। রুমে ঢুকে দেখলাম জেমসের ভ্রু কুঁচকে আছে। কারণ জানতে চাইলে বললো কাজে লাগতে পারে এরকম কোন তথ্যই নাকি সে সংগ্রহ করতে পারেনি। হয় রেস্টুরেন্টের কর্মচারীরা অতি চালাক না হলে আমিই আসল অপরাধী। যদিও সবাই বলেছে আমি চুরি করতে পারি এটা তারা কোন ভাবেই বিশ্বাস করতে পারছে না। বিশেষত জেনিফার বলেছে এটা সে কোন দিনও বিশ্বাস করবে না। মার্ক এবং ড্যানিয়েলের অভিমতও তাই তবে ড্যানিয়েল নাকি এটাও বলেছে যে কখনও কখনও মানুষ বদলেও যায় তবে আমার মধ্যে সেরকম কোন চিহ্ন সে দেখেনি।

আমি জেমসকে অনুরোধ করলাম আমাকে আরো কিছুদিন সময় দিতে। জেমস গম্ভিরভাবে বললো যা করার যেন দ্রুত করি। না হলে হয়তো আমাকে সে গ্রেফ্তার করতে বাধ্য হবে।

আমিও বুঝতে পারছিলাম এই কেসের কোন সমাধান করতে না পারলে হয়তো আমাকেই জেলে যেতে হবে। আবারও চিন্তা করতে শুরু করলাম। অদৃশ্যে কোথায় যেন একটা সূত্র দেখতে পাচ্ছিলাম। কিন্তু বিচ্ছিন্ন। জোড়া দিয়ে মালা গাঁথার মত অবস্থায় তখনও আসেনি। তবে আমার হাতে সময় ছিল খুব কম। তাই নিজেকে বোঝালাম যা করতে হবে খুব দ্রুত করতে হবে।

এত ঘটনার পরও মালিক তখনও আমার উপর আস্থা রেখে চলেছে আগের মত। কাজ থেকে ছাড়ানোতো দূরে থাক বরং বরাবরের মত আমাকে সে পূর্ণমাত্রায় বিশ্বাস করছিল এত ঘটনার পরও। হয়তো তার জন্য বিষয়টা ততটা চিন্তার ছিলনা কেননা রেস্টুরেন্টের নামে ইনসুরেন্স করা ছিল। ফলে ক্ষতিপূরণবাবদ হয়তো সে যে টাকা চুরি গিয়েছে তার থেকে বেশিই পেতো।

যাইহোক, অন্যসব দিনের মত আমার নিয়মিত রুটিন একই রইলো। পরদিন সকালে রেস্টুরেন্টের জন্য কাঁচা খাবার কিনতে পাশের শহরের একটা পাইকারী দোকানে গেলাম। যা যা কেনার সেগুলো অর্ডার করে বসেছিলাম ডেলিভারীর অপেক্ষায়। কিন্তু সেখানেও আমার মাথায় বারবার ঘুরপাক খাচ্ছিল একই ঘটনা। কে করলো এই চুরি এবং কিভাবে?

এক সময় বিরক্ত হয়ে মনটা অন্যদিকে নিয়ে যেতে চাইলাম। কিন্তু বৃথা চেষ্টা। যাই চিন্তা করার চেষ্টা করি মনে পড়ছিল শুধু চুরির ব্যাপারটা। তাই সামনে রাখা পুরোনো ম্যাগাজিনের স্তুপ থেকে একটা ম্যাগাজিন তুলে পড়তে শুরু করলাম। পড়তে পড়তে একটা আর্টিকেলে আমার চোখ আটকে গেলো। হঠাৎ করে অনুভব করলাম আমার রক্তে যেন ঝড় উঠতে শুরু করেছে। কেন যেন মনে হাচ্ছিল বিচ্ছিন্ন মালার জোড়াটা আমি দেখতে পাচ্ছি। ততক্ষণে আমার ডেলিভারীও তৈরী। কাউন্টারে আমার টোকেন নাম্বার দেখাচ্ছে। দ্রুত কাউন্টারে গিয়ে অনুরোধ করলাম ম্যাগাজিনটার একটা অংশ জেরক্স করে আনার সুযোগ দেয়ার জন্য। কাউন্টারের ছেলেটা হেসে বললো এটাতো অনেক পুরোনো ম্যাগাজিন। জেরক্স করার প্রয়োজন নেই। আমি চাইলে পুরো ম্যাগাজিনটাই নিতে পারি।

ছেলেটার অমায়িক ব্যবহারে মুগ্ধ হলাম। তাকে ধন্যবাদ দিয়ে জিনিসগুলো নিয়ে আমি প্রায় ঝড়ের গতিতে ইনভারক্লাইডের বাস ধরার জন্য বের হলাম। পথে বাসে ম্যাগাজিন থেকে পুরো আর্টিকেলটা আবার পড়লাম। আমার মন তখন বলছে এ কেসের মূল অংশ আমি সমাধান করে ফেলেছি।

রেস্টুরেন্টে ফিরে প্রথমেই আমি কাউন্টারে গিয়ে ইন্সপেক্টার জেমসের দেয়া টর্চলাইটটা খুঁজলাম। কিন্তু পেলাম না। জেনিফারকে জিজ্ঞেস করার পর জানতে পারলাম লাইটটা ইন্সপেক্টার গতকাল সাথে করে নিয়ে গিয়েছে। ফলে দ্রুত আবার ছুটলাম থানার দিকে। জেমস এই অসময়ে আমাকে দেখে একটু অবাক হলো। আমি তাকে শুধু জানালাম কেসটা সম্ভবত আমি সমাধান করে ফেলেছি। আমার তার টর্চলাইটটা প্রয়োজন। জেমস অবাক হয়ে আমার মুখের দিকে কিছু সময় তাকিয়ে রইলো। তারপর ড্রয়ার থেকে টর্চটা বের করে দিল। লাইটটা হাতে নিয়ে আমি বিভিন্ন অপশনের দিকে তাকিয়ে হাসলাম। মিলে যাচ্ছে সব। জেমস তখনও অন্ধকারে। বললো সবকিছু খুলে বলতে। আমি জানালাম খুলে বলার মত তেমন কিছু নেই। যদি সে ম্যাজিক দেখতে পছন্দ করে তাহলে আমার সাথে আসতে পারে। জেমসের বোকার মত চেয়ে থাকাটা সেদিন বেশ উপভোগ করছিলাম। স্কটল্যান্ডের পুলিশ ইন্সপেক্টার আমার কথার হেয়ালীতে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। ভাবতেই ভালো লাগছিল।

অল্প কিছু সময়ের মধ্যেই আমরা ফিরে আসলাম রেস্টুরেন্টে। আমি এবং জেমস লকার রুমে ঢুকে দরজাটা আটকে দিলাম। তারপর লাইট নিভিয়ে এবং পর্দা টেনে রুমটা অন্ধকার করে ফেললাম। এর পর টর্চটায় ব্ল্যাক লাইট বলে একটা অপশন ছিল, সেটা সিলেক্ট করে লকারের উপর ফেললাম। সাথে সাথে ম্যাজিকের মত কাজ হলো। লকারের উপর কিছু নীল আলো জ্বলে উঠলো। আমি গিয়ে লকারের ডালাটা খুলে কম্বিনেশন নাম্বার ইনপুট দেয়ার প্যাডটার উপর টর্চটা ধরলাম। যা ভেবে ছিলাম ঠিক তাই। ১, ৭ এবং ৯-এর উপর নীল আলো জ্বলে আছে। ইন্সপেক্টার তখন একটু একটু করে করে বুঝতে শুরু করেছে। তাই আমার দিকে স্বপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকালো। আমি হেসে বললাম, তুমি ঠিকই ধরেছো। প্রোপাইলেন গ্লাইকল মনোমিথাইল ইথার-এর ম্যাজিক এটা!”

এ পর্যন্ত বলে শারদদা থামলেন। আমরা এত সময় যেন দমবন্ধ করে শুনছিলাম। শারদদা থামার সাথে সাথে রায়হান প্রায় চিৎকার করে বললো, “ন্যাশনাল ট্রেজার!”

শারদদা হেসে রায়হানের পিঠ চাপড়ে দিলেন। তারপর বললেন, “হ্যা। ঠিকই ধরেছো। হলিউড চলচিত্র ন্যাশনাল ট্রেজারে এরকমই কিছু একটা দেখানো হয়েছে। তবে ছবিটায় এ বিষয়ে কোন তথ্য দেয়া হয়নি। ফলে দর্শক দেখার পর বরাবরের মত একটা আজগুবী কিছু দেখানো হয়েছে বলে ধরে নিয়েছে। প্রকৃত ঘটনা হলো প্রোপাইলেন গ্লাইকল মনোমিথাইল ইথারকে কিটোনের সাথে মিশিয়ে একটা সলিউশন তৈরী করা যায় যেটা কেবল আল্ট্রা ভায়োলেট রশ্মির নিকটবর্তি তরঙ্গ দৈর্ঘ্যেই দেখা সম্ভব। এ রশ্মিকে ব্ল্যাক লাইট বলা হয় যা দৃশ্যমান রশ্মির খুব কাছাকাছি অবস্থান করে। সাধারন আলোতে সলিউশনটা দেখা যায় না কিন্তু অন্ধকারে যদি এর উপর ব্ল্যাক লাইট ফেলা হয় তাহলে নীলচে ভাবে জ্বলে উঠে। এই বিশেষ প্রযুক্তির সুবিধা নিয়ে সেদিন আমাকে বোকা বানানো হয়েছিল। ম্যাগাজিনের সেই আর্টিকেলটা না পড়লে হয়তো এ ধাধার সমাধান করা সম্ভব হতো না। যাইহোক, যে চুরিটা করেছে সে কোনভাবে আমার হাতে সলিউশনটা লাগিয়ে দিয়েছিল। এই সলিউশনের আরেকটা বিশেষত্ব হচ্ছে এটা শুকিয়ে গেলেও স্পর্শের সাথে সাথে অন্য যায়গায় লেগে যায়। ফলে আমি যখন লকারে ক্যাশ রাখতে কম্বিনেশন নাম্বার প্রবেশ করাই তখন সলিউনটা আমার হাত থেকে লকারের কম্বিনেশন টাইপ করার প্যাডে লেগে যায় এবং সেই সূত্র ধরেই চোর লকারটা খুলতে সক্ষম হয়েছিল।

সেদিন রাতে আমি যখন আবার লকার রুমটা সার্চ করতে এসেছিলাম তখন কোন ভাবে চাপ লেগে ব্ল্যাক লাইট অপশনটা অন হয়ে গিয়েছিল। ব্ল্যাক লাইট যেহেতু জ্বললেও দেখা যায় না, আমি তাই সেটা লক্ষ্য করিনি। লকারের কভারে আমারই হাতের অঙ্গুল থেকে সলিউশনটা লেগেছিল খোলার সময়। সে দাগগুলোকেই আমার কাছে নীল জোনাকির মত মনে হয়েছিল।

ইন্সপেক্টার জেমসকে সব কিছু খুলে বলার পর জেমস বললো তাহলেতো লকারে চারটা নাম্বারে নীল চিহ্ন থাকার কথা যেহেতু কম্বিনেশন কোড চার ডিজিটের। তাছাড়া শুধু নাম্বারগুলো জানলেওতো চলবে না। কোনটার পর কোনটা সেটাও জানতে হবে। এবং সবচেয়ে বড় কথা লকার রুমের মূল দরজাইবা খুললো কি করে?

আমি হেসে বললাম, সব বলবো। তুমি শুধু আগামী কাল এই ঘরে একটা মিটিং কল করো। সাথে এটাও নিশ্চিত করো যেন মিটিং-এ আমার রেস্টুরেন্টের মালিক, মার্ক, ডেনিয়েল এবং জেনিফার অবশ্যই উপস্থিত থাকে।

আমার হাসি দেখে জেমস বুঝে গিয়েছিল পেট থেকে হয়তো আর কোন কথা বের করবো না আমি। তাই সেদিনের মত বিদায় নিয়ে উঠে দাড়ালো। যাবার বেলায় আমি আবারও মনে করিয়ে দিলাম উল্লেখিত চার ব্যাক্তির উপস্থিত থাকার বিষয়টা। জেমস হেসে আমাকে আস্বস্ত করে বললো ওরাতো থাকবেই; সাথে আরো দুজনকে নিয়ে আসবে যাতে ওদের মধ্যে এক বা একাধিক ব্যাক্তিকে সাদরে অন্দরমহলে নিয়ে যাওয়া যায়।

তরল – ২ (শারদদা সিরিজের গল্প)

এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান