তরল – ১ (শারদদা সিরিজের গল্প)


“আরে দেখি, দেখি!”

পুরোনো ওষুধের বোতলটা যখন মানিক ফেলতে যাচ্ছিল তখন প্রায় কেড়েই নিলেন শারদদা। তারপর ভালো করে তাকিয়ে দেখলেন কিছু সময়। এরপর হতাশ ভাবে বললেন, “আচ্ছা ফেলেই দাও”।

আজ সকাল থেকে মেসটা পরিষ্কার করছি সবাই। শারদদা খুব একটা কাজ করছেন না, তবে কিভাবে কাজ করতে হয় সে বিষয়ে বিভিন্ন জ্ঞানগর্ভ মন্তব্য ইতিমধ্যে শুনতে শুনতে আমরা অস্থির। অপু একবার নিচু স্বরে বলেছিল বলার থেকে করে দেখানোটা কি শিক্ষার ক্ষেত্রে অধিক উপযোগী নয়? কিন্তু অপুর বলা কথাটার কম্পাঙ্কই হয়তো শারদদার কানের জন্য উপযোগী ছিল না। তাই শুনেও শুনতে পাননি তিনি। তবে শারদদার একনিষ্ঠ ভক্ত ইদ্রিস ঠিকই শুনেছিল এবং সাথে সাথে চটে উঠে অপুকে দু’কথা শুনিয়ে থামিয়েছে। এরপর আর কেউ শারদদাকে কিছু করার ব্যাপারে অনুরোধ করেনি। তিনিও নুতন উদ্যামে উপদেশ দিয়ে যাচ্ছিলেন। এরকম সময় হঠাৎ পুরোনো ওষুধের বোতলগুলো থেকে একটা বড় বোতল যখন মানিক ফেলতে যাচ্ছিল তখনই শারদদা “দেখি দেখি” বলে আর্তনাদ করে উঠলেন।

মানিক তখনও বোতলটা হাতে নিয়ে দাড়িয়ে আছে। কি করবে বুঝতে পারছে না। মানিকের দ্বিধান্বিত চেহারা দেখে শারদদা মলিন ভাবে হেসে বললেন, “ফেলেই দাও। যা ভেবেছিলাম তা নয়।”

শারদদার সব কথাতেই ইদ্রিস এখন অতি উৎসাহী। সাথে সাথে বললো, “কি ভেবেছিলেন শারদদা?”

পাশের চেয়ারটা টেনে নিয়ে, যেন এতক্ষন কাজ করে ক্লান্ত, এভাবে বসতে বসতে শারদদা বললেন, “প্রোপাইলেন গ্লাইকল মনোমিথাইল ইথার।”

ইদ্রিস স্বপ্রশ্ন দৃষ্টিতে প্রথমে তাকালো আমার দিকে। কিন্তু আমার মুখের অবস্থা দেখে সুবিধা হবে না বুঝতে পেরে পর মুহূর্তে তাকালো মানিকের দিকে। সেখানেও অবস্থা অভিন্ন। কথাটা রায়হান আর অপুর কানেও গিয়েছিল। ওরাও ইতিমধ্যে আমাদের পাশে এসে দাড়িয়েছে। তারপর একসাথে সবাই মিলে যে প্রশ্নটা শারদদার দিকে ছুড়ে দিলাম সেটা হলো – “এটা কি জিনিস শারদদা?”

শারদদা হাসলেন। তারপর বললেন, “এ এক ইতিহাস। এক কথায় জবাব দেয়া সম্ভব নয়।”

গল্পের গন্ধ পেয়ে সাথে সাথে ইদ্রিস বললো, “এক কথায় কে বলতে বলেছে আপনাকে? আপনি খুলেই বলেন। তবে পাঁচ মিনিট পর। আমি এক দৌড় দিয়ে ডালপুরি নিয়ে আসি।”

“এই অসময়ে ডালপুরি?” মানিক বাধা দেয়ার চেষ্টা করেছিল। তবে ইদ্রিসের কানে সে কথা পৌছায়নি। ততক্ষনে সে শরীফের দোকানে হয়তো!

পরবর্তি দশ মিনিটের মধ্যে আসন পেতে আমরা গোল হয়ে বসে শারদদাকে ঘিরে ধরেছি। গরম গরম পুরির গন্ধ মনে হয় শারদদাকে ভেতর থেকে রসদ যোগাচ্ছিল। পুরিতে কামড় দিতে দিতে উৎফুল্ল গলায় শারদদা বললেন, “বছর পাঁচেক আগের ঘটনা। তখন থাকি ইউরোপের এক অনিন্দ সুন্দর দেশ স্কটল্যান্ডে।”

ইদ্রিস কথার মাঝখানে ফোড়ন কেটে বললো, “হ্যা, হ্যা। স্কটল্যান্ড ইয়ার্ড। শার্লক হোমসের বইতে পড়েছি।”

শারদদা হেসে বললো, “ওটা আসলে ইংল্যান্ডের গ্রেটার লন্ডন পুলিশ বিভাগের হেডকোয়ার্টারের নাম। এ নামের পেছনে ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট রয়েছে, সে গল্প অন্য একদিন বলবো। শুধু এতটুকু জেনে রাখ স্কটল্যান্ড হলো ইংল্যান্ডের উপরের দিকে গ্রেট বৃটেন দ্বীপে অবস্থিত আরেকটি দেশ। যে চারটি দেশ মিলে যুক্তরাজ্য গঠন করেছে স্কটল্যান্ড তাদেরই একটি।”

“আচ্ছা।” যেন অনেক কিছু বুঝে ফেলেছে এভাবে ইদ্রিস মাথা নাড়লো।

শারদদা বলে চললেন, “আমি থাকতাম ইনভারক্লাইড নামে স্কটল্যান্ডের একটা ছোট শহরে। কথিত আছে স্কটল্যান্ডের প্রকৃতির মত প্রশাসন, মানুষ এবং জীবনও নাকি বিশুদ্ধ। বলা হয় যে কোন কিছুর শুদ্ধতম রুপ দেখতে চাইলে স্কটল্যান্ড যাও। কিন্তু দুর্ভাগ্য, আমার জীবনে বিষয়টা উল্টা হয়ে গেলো।”

শারদদা একটু থেমে আরেকটা ডালপুরি তুলে নিলেন। তারপর আবার বলতে শুরু করলেন, “আমি কাজ করতাম একটা রেস্টুরেন্টের ম্যানেজার হিসেবে। আমার কাজ ছিল সব কিছু গুছিয়ে রাখা, বিশেষত ক্যাশ। কাজটা আমি বেশ বিশ্বস্ততার সাথেই করছিলাম গত ছয় মাস। কোনদিন একটা পাউন্ডও এদিক সেদিক হয়নি। আমার উপর অ্যালবার্ট অর্থাৎ রেস্টুরেন্টের মালিকের আস্থাও ছিল প্রবল।

যাইহোক, সে বছরের থার্টি ফার্স্ট ডিসেম্বরের রাতে নিউইয়ার পার্টি করতে অনেক মানুষ আসলো আমাদের রেস্টুরেন্টে। হু হু করে বিক্রি হচ্ছিল খাবার এবং পানীয়। ক্যাশের দিকে তাকিয়ে দেখলাম এত বিক্রি গত ছয় মাসে হতে দেখিনি। পার্টি চললো শেষ রাত পর্যন্ত। ভোরের দিকে দোকানের কর্মচারীদের যা যেমন আছে তেমন রেখেই চলে যেতে বলি। সেদিন সবার পরিশ্রমও হয়েছিল অনেক। তাই জনুয়ারীর প্রথম দিন ছুটি কাটিয়ে পরদিন একটু আগে আগে আসতে বললাম সব কিছু পরিষ্কার করার জন্য।

ক্যাশ রাখার জন্য আমাদের একটা লকার রুম আছে। ওখানেই সব সময় ক্যাশ রাখি। পরে এক সময় অ্যালবার্ট এসে ক্যাশ গুনে নিয়ে যায়। সবাই চলে যাওয়ার পর আমি ক্যাশ গুনে লকারে ভরে রুমটা লক করে রেস্টুরেন্ট থেকে বের হয়ে আসি। এরপর সাটার নামিয়ে তালা দিয়ে কাছেই আমার বাসায় চলে যাই।

একদিন বাদে আবার আমরা রেস্টুরেন্ট খুললাম। মালিক আসলো ক্যাশ নিতে। আমি তার সাথে লকার রুমে ঢুকে যেই লকার খুলেছি, আমার মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়লো। ক্যাশে একটা পাউন্ডও নেই। অথচ আমি নিজ হাতে ক্যাশ গুনে গুছিয়ে রেখে গিয়েছিলাম। কি বলবো বুঝতে পারছিলাম না। অ্যালবার্ট বললো আবার মনে করে দেখতে অন্য কোথাও রেখেছি কি না। কিন্তু আমি কি করে বোঝাই ক্যাশ আমি এখানেই রেখেছিলাম!

এরপর অ্যালবার্ট নিজেই পুলিশকে খবর দিলো। স্থানীয় থানার ইন্সপেক্টার জেমস্ ব্রুস আধ ঘন্টার মধ্যে আমাদের রেস্টুরেন্টে আসলো। হালকা ছিপছিপে গড়নের ভদ্রলোককে দেখলে প্রথমে পুলিশ বলে মনেই হয় না। কিন্তু যখন কথা বলেন তখন তার গলার স্বর বলে দেয় এ লোক যুক্তরাজ্যের বনেদি পুলিশ বিভাগগুলোর একটা স্কটল্যান্ড পুলিশ থেকে এসেছে।

ইন্সপেক্টার জেমস্ লকার ঘরটা ভালো করে দেখে আমাকে এসে জিজ্ঞেস করলো সেদিন আমি ঠিক মত ঘরটার দরজা আটকেছিলাম কিনা। এখানে বলে রাখি স্কটল্যান্ড-আয়ারল্যান্ডের দিকের দরজাগুলোও ঐতিহ্যবাহী। ওদের দরজার লকগুলো অনেকটা অংটার মত হয়। ভেতর থেকে ঘোরালে খুলে যায়। বাহির থেকে চাবি দিয়ে খুলতে হয়। এমনকি ঘোরানর মত কোন নবও থাকে না। দরজা আটকানোর পর আপনাআপনি লক হয়ে যায়। আমি প্রতিদিন দরজা আটকে বারদুয়েক ভেতরে চাপ দিয়ে দেখি ঠিক মত লক হয়েছে কি না। ইন্সপেক্টারকে সে কথা খুলে বললাম। তাছাড়া লকারে একটা ইলেকট্রিক কম্বিনেশন লক রয়েছে যেখানে ক্যালকুলেটারের মত একটা প্যাড থেকে চার সংখ্যার একটা নাম্বার দিতে হয় খোলার জন্য। এই কম্বিনেশন নাম্বারটাও আমি ছাড়া আর কেউ জানে না, এমন কি মালিকও নয়। যেহেতু লকার খোলা হয়েছে, অতএব এ নাম্বারটাই ব্যবহার করা হয়েছে। তাছাড়া লকারে কোন প্রকার আঘাতের চিহ্ন নেই। দেখেই বোঝা যাচ্ছিল জোর করে এটা খোলার চেষ্টা করা হয়নি।

ইন্সপেক্টার আমার দিকে তাকিয়ে শীতল ভাবে বললো আমি সম্ভবত সমস্যায় পড়তে যাচ্ছি। অতএব যা সত্য এখনই যেন বলে ফেলি। আমি কিছু না বলে বসে রইলাম। কিছু আসলে আমার বলারও ছিল না। যা সত্য সবই আমি তাকে ইতিমধ্যে জানিয়ে ফেলেছি।

বিকেলের দিকে থানা থেকে টেলিফোন আসলো। ফিঙ্গার প্রিন্ট এক্সপার্ট জানিয়েছে লকারে শুধু আমারই আঙ্গুলের ছাপ পাওয়া গিয়েছে। হয়তো ইন্সপেক্টার জেমসের সন্দেহ আরো বেশি ঘনিভুত হয়েছে আমার উপরে। তাই সে আমাকে একবার থানায় যেতে বলেছে। ভেবে দেখলাম ঘাবড়ে গিয়ে লাভ নাই। সত্যকে সরাসরি মোকাবেলা করতে হবে।

স্কটল্যান্ডের শীত রীতিমত হাড়কাঁপানো। তার উপর ইদানিং রাতে কুয়াশা পড়ছে প্রচুর, ফলে শীত যেন আরো বেশি অত্যাচার শুরু করেছে। তাছাড়া এখানে শীতের সময় বিকেল চারটার পরপরই সূর্য ডুবে যায়। তাই ওভারকোটটা ভালো করে গায়ে দিয়ে, মাফলারে গলা ঢেকে তারপর থানার উদ্দেশ্যে বের হলাম।

থানায় পৌছে দেখি ইন্সপেক্টার আমার জন্য অপেক্ষা করছে। দ্রুত তার কক্ষে গিয়ে দেখা করলাম। আমাকে দেখে সে মুচকি হাসলো। তার পর বসতে বলে কফি আনতে গেলো নিজেই। বুঝলাম না ঠিক কি বলতে চাইছে। ডেকে আনার ধরণে মনে হচ্ছিল যেন বাংলাদেশি পুলিশের মত মারধর করবে। কিন্তু বাস্তব চিত্র বেশ অন্যরকম।

কফি এনে আমার সামনে বসলো সে। একটা মাগ আমার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললো খেয়ে দেখো। আমার বানানো ব্ল্যাক কফি সবারই ভালো লাগে। কফিটা সত্যিই মন্দ ছিল না। খেতে খেতে কেস নিয়ে কথা বলতে লাগলাম। আমি তখনও বুঝতে পারিনি আমাকে ডেকে আনার কারণটা। ধীরে ধীরে ইন্সপেক্টারের গলার স্বর বদলে যেতে শুরু করলো। এক সময় সে সরাসরি আমাকে বললো চুরির অভিযোগ স্বীকার করে নিতে না হলে তার কাছে নাকি একশ একটা রাস্তা আছে আমাকে দিয়ে স্বীকার করানোর। তাছাড়া সব প্রমান স্পষ্ট ভাবে জানিয়ে দিচ্ছে এটা আমারই কাজ।

আমি হেসে বললাম, তুমি চিন্তা করে দেখো প্রমান আমার দিকে ইঙ্গিত করলেও যুক্তি কি আমাকে অপরাধী মানতে রাজী হচ্ছে?

ইন্সপেক্টার একটু অবাক হয়ে খুলে বলতে বললো। আমি তাকে বললাম, যদি আমি সত্যিই চুরি করতাম তাহলে বিষয়টা এতটা খোলাখুলি ভাবে কি আমার দিকে টেনে আনতাম? চুরির দিন আমিই সবার শেষে রেস্টুরেন্ট থেকে বের হয়েছি। দরজার চাবিও আমার কাছেই থাকে। লকারের কম্বিনেশনও শুধু আমিই জানি। যেন আমি এত বোকা যে সব জেনে শুনে নিজের ঘাড়ে চাপাচ্ছি। তাছাড়া সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো আমি চুরি করলে এখানে তোমার সামনে বসে থাকতাম না বরং পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করতাম। একবার যদি আমি যুক্তরাজ্য থেকে বের হতে পারতাম তহলে স্কটল্যান্ড, ইংল্যান্ডের সব পুলিশ মিলেও তোমরা আমাকে আর ছুঁতে পারতে না। তারপর জানালাম এই শীতের বিকেলে খবর দেয়ার সাথে সাথে থানায় ছুটে আসার মূল কারণ আমি তাকে কেসের ব্যাপারে সাহায্য করতে চাই।

ইন্সপেক্টার জেমস আমার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো বেশ কিছু সময়। তারপর বলল যদিও সে আমাকে বিশ্বাস করতে পারছে না, তবে সে চায় আমাকে একটা সুযোগ দিতে। আমি হেসে বললাম, আমি নিরুপায়; অতএব সুযোগ আমি নিচ্ছি। আমি চেষ্টা করবো সর্বাত্বক সাহায্য করতে যাতে প্রকৃত অপরাধী ধরা পড়ে। এরপর আমরা পরিকল্পনা করলাম যে ইন্সপেক্টার সবাইকে বলবে সে ধারনা করছে আমিই চুরিটা করেছি এবং সে জন্য সে আমার ব্যাপারে সবার কাছ থেকে তথ্য সংগ্রহের চেষ্টা করবে যাতে অভিযোগ প্রমান করা সম্ভব হয়। এই তথ্য সংগ্রহের নাম করেই প্রধানত অন্যদের জেরা করা হবে। এই পরিকল্পনার মূল কারণ ছিল আমরা চাচ্ছিলাম না অন্যরা বুঝতে পারুক সন্দেহ এখন তাদের উপরে চলে এসেছে।

সেদিনের মত পরিকল্পনা শেষ করে আমি উঠে দাড়ালাম। রাতও তখন অনেক। প্রায় দশটা। যে দেশে বিকেল চারটায় সন্ধ্যা নামে সেখানে রাত দশটা মানে বেশ রাত। ইন্সপেক্টার জেমস মানুষ খারাপ ছিল না। নিজ থেকে গাড়ি দিয়ে বাসায় পৌছে দিতে চাইলো। তবুও আমি না করলাম কারণ সেটা আমাদের পরিকল্পনাকে ক্ষতিগ্রস্থ করতে পারে। কেউ যদি দেখে যাকে আসামী ভাবছে ইন্সপেক্টার তাকেই কুয়াশাচ্ছন্ন শীতের রাতে গাড়ি করে বাড়ি নামিয়ে দিয়ে যাচ্ছে, ব্যাপারটা বেশ সন্দেহের সৃষ্টি করবে। আমার যুক্তি শুনে জেমস খুশি হলো। তারপর একটা টর্চ লাইট দিয়ে বললো অন্তত এটা নিয়ে বাড়ি যেতে। লাইটটা শুধু টর্চই না। বিভিন্ন অপশন রয়েছে তাতে। তার মধ্যে একটা ফগ লাইট। রাতের কুয়াশা ভেদ করে পথ চলতে যাতে সমস্যা না হয় সে জন্যই দেয়া।

আমি জেমসকে ধন্যবাদ দিয়ে রাস্তায় বের হয়ে আসলাম। মাথায় তখন একটাই চিন্তা, কে করতে পারে এই কাজ? যেই করুক সে পরিষ্কার ভাবে আমাকে ফাঁসিয়েছে। এটা কি আমার প্রতি বিদ্বেষ থেকে নাকি নিতান্তই একটা চুরি? এছাড়াও সবচেয়ে বড় চিন্তা, চুরিটা করলো কি করে? দরজা খোলার একটা সম্ভাব্য সমাধান আমি খুঁজে পেয়েছি কিন্তু লকার? সেটা তো কম্বিনেশন জানা না থাকলে খোলা সম্ভব নয়। তাছাড়া আমার কম্বিনেশন নাম্বারটা যত্রতত্র ব্যবহৃত কোন নাম্বার নয় যে এত সহজে অনুমান করে নিবে। চিন্তাগুলো মাথায় ঘুর পাক খেয়ে খেয়ে অস্থির করে তুলছিল।

আমি যখন রাস্তায় হাটছি তখন চারদিক নিরব। কোন জনমানবের চিহ্ন পর্যন্ত নেই। কুয়াশা যেন আরো বেড়েছে। ফগ লাইটটের আলোয় পথ চলতে সমস্যা হচ্ছিল না কিন্তু লাইটটা না থাকলে সমস্য হতো নিশ্চিত করে বলা যায়। মনেমনে জেমসকে আবার ধন্যবাদ দিলাম।

হঠাৎ মনে হলো এখন বাড়ি ফিরে না গিয়ে বরং লকার রুমটা আরেকবার ভালো করে খুঁজে দেখি। যদি কোন ক্লু আবিষ্কার করতে পারি। দ্রুত ফেরার পথ পরিবর্তন করে রেস্টুরেন্টের দিকে চলে এলাম। আজ মালিকই রেস্টুরেন্ট বন্ধ করেছে। তবে তালার চাবির দুটা সেট রয়েছে। একটা মালিকের কাছে, আরেকটা আমার কাছে। ফলে ঢুকতে কোন সমস্যা হলো না।

লকার রুমে গিয়ে আবারও চার দিক খুঁজে দেখতে শুরু করলাম। রুমটা মোটামোটি বড়। একটা টেবিল আছে। ছোট একটা টয়লেটও আছে যদিও ব্যবহার করা হয়না বরং এখন গুদাম হিসেবে বেশ কার্যকরি। কাগজপত্র রাখার একটা সেল্ফও আছে। টর্চটা জ্বেলে টয়লেটটা ভালো করে দেখলাম। কিছু পাওয়ার আশা করা বৃথা কারণ পুলিশ এটাও ঘেটে ফেলেছে। ধুলায় তাদের বুটের দাগ দেখতে পেলাম। সেল্ফের কাগজপত্র নেড়ে বুঝলাম এখানেও একই অবস্থা।

খানিকটা হতাশ হয়ে যখন বের হয়ে আসছিলাম তখন একটা ঘটনা ঘটলো। রুমের হিটার এবং লাইট নিভিয়ে বের হয়ে আসার সময় টর্চ দিয়ে পুরো রুমটা আবার একবার দেখে নিচ্ছিলাম। তখন টর্চের আলোতে রুমের এক প্রান্তে খুব ছোট নীল রঙ্গের একটা কিছু নড়তে দেখলাম। দ্রুত লাইট জ্বলিয়ে যেই দেখতে গেলাম ততক্ষণে সেটা গায়েব হয়ে গিয়েছে। ঠিক বুঝতে পারলাম না জিনিসটা কী ছিল। পোকার মত কয়েকটা বিন্দু বিন্দু ছিল। অনেকটা জোনাক পোকার মত তবে নীল রঙ্গের।

যাইহোক, সারা দিনের ধকলে তখন দুচোখ বন্ধ হয়ে আসছিল। তাই ঠিক করলাম সেদিনের মত সব চিন্তাকে ছুটি দিয়ে একটা হট শাওয়ার নিয়ে ঘুমিয়ে পড়বো। সেদিন সবকিছু গুছিয়ে, রেস্টুরেন্ট তালা দিয়ে আমি যখন বাসাই পৌছি, ঘড়ির কাটা তখন বারোটা ছুঁইছুঁই করছিল। (চলছে)

তরল – ১ (শারদদা সিরিজের গল্প)

এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান