ব্রোকেন হার্ট তরুণ, ফরাসী তরুণীদ্বয় এবং হার্টব্রেকার


একদিনের ঘটনা, হঠাৎ মুভি দেখার ইচ্ছে জাগলো। ব্যাপারটা এমন না যে কালে-ভাদ্রে মুভি দেখি। আগে মাসে কম করে হলেও ২০টা মুভি সিনেমায় গিয়ে দেখা হতো। এখনও সংখ্যাটা দশের মধ্যে আছে। তবে মাঝে কিছুদিন দশ-বছরের-প্রেমিকা-কর্তৃক-ছ্যাক-প্রাপ্ত হইয়া মুভি দেখাই বন্ধ করে দিয়েছিলাম। তারপর মনে হলো আবার মুভি দেখা শুরু করবো। কী আছে জীবনে? ভগ্ন হৃদয় নিয়ে মুখ থুবড়ে ঘরে পড়ে থাকার কোন মানে হয় না। অতঃপর আবার সিনেমামুখী হওয়া।

বক্স অফিসে দাঁড়িয়ে আছি। ঠিক বুঝতে পারছি না কোন মুভি দেখবো। সিনেওয়ার্ল্ড ডাবলিন-এ সতেরটা স্ক্রিনে সারাদিন মুভি চলে। মনেমনে ঠিক করলাম এখন যে মুভিই শুরু হচ্ছে, সেটাই দেখবো। কাউন্টারে উপবিষ্ট হাস্যজ্জল তরুণীকে যে কোন একটা মুভির টিকেট দেয়ার কথা বলায় সে “হার্টব্রেকার” নামের একটা মুভির টিকেট দিল। আহ! মুভির নাম দেখেই বুকের মধ্যে ব্যথা শুরু হলো! মানুষ এখন লং ডিসটেন্স প্রেম করে। আমি রিয়েল প্রেম করে লং ডিসটেন্সে ছ্যাকা খাই। তারপর আমার ভাগ্যে যে মুভি পড়ে সেটার নাম হয় হার্টব্রেকার। পোড়া কপাল একেই বলে।

যাইহোক, থিয়েটারে গিয়ে বসলাম। একসময় মুভি শুরুও হলো। কিন্তু আমি কিছু বুঝি না। কথা বার্তা সব আরবীতে বলছে। বুঝলাম নায়ক অতি পারঙ্গম। আরব আমিরাতের মরুভূমিতে তিনি কথাবার্তা সব আরবীতে বলছেন। নীচে ইংরেজী সাব-টাইটেল। বুঝতে অসুবিধা হচ্ছে না। আহ, কত নাটক করে আরেকজনের হৃদয় ভাঙছেন নায়ক। অতঃপর পেমেন্ট নিয়ে তারা ইউরোপে উড়াল দিলেন। মনে মনে বললাম, এই বেলায় সাব-টাইটেল পড়া বন্ধ করার সময় এসেছে। কিন্তু হায়! নায়ক এবার এমন করে কথা বলে কেন? প্রথমে ভাবলাম এটা কি খুব কঠিন কোন ইংরেজীর এ্যাকসেন্ট? তা তো হবার কথা না। আইরিশ এ্যাকসেন্ট যখন জলবৎতরলং হয়ে গিয়েছে, এক অস্ট্রেলিয়ান এ্যাকসেন্ট ছাড়াতো আর কিছু আমার কাছে দুর্বোধ্য লাগার কথা না। নাহ। এটা ইংরেজীই না। নিচে তখনও সাব-টাইটেল চলছে!

আমি আড় চোখে লক্ষ্য করলাম আমার ঠিক পাশে উপবিষ্ট দুই তরুণী দারুণ মজা করে মুভি দেখছে। দেখতে দেখতে নিজেদের মধ্যে হেসে গড়িয়েও পড়ছে। অন্ধকার থিয়েটারে স্ক্রিনের আলো এসে মাঝে মাঝে তাদের মুখে পড়ছে। সেই আলোয় আমি তাদের দেখছি আর মনেমনে বলছি, “ধুর ছাই! বাংলাদেশী মেয়ের পেছনে জীবনের সুবর্ণ দশটা বছর নষ্ট করলাম। এর থেকে ইউরোপিয়ান মেয়ের সাথেই প্রেম করলে ভালো হতো।” পরক্ষণে অবচেতন মন আমাকে বলে, “নিয়াজ আস্তে। ট্রেন মিস হয়েছে বলে এখন যে কোন গন্তব্যের ট্রেনে উঠে পড়লে চলবে না।” আমি মনকে একটা ধমক দিয়ে থামিয়ে দেই। তারপর মুখে অমায়িক একটা হাসি নিয়ে (যদিও দরকার ছিল না। অন্ধকারে সেই হাসি দেখা যাচ্ছিল না) ঠিক পাশের মেয়েটাকে জিজ্ঞেস করলাম,
“এই মুভিটা কোন ভাষার?”
“এটা ফ্রেন্চ মুভি।” হাসি হাসি মুখে মেয়েটা উত্তর দেয়।

আমি চোখ গোল গোল করে চিন্তা করতে থাকি। কিন্তু হার্টব্রেকার কী করে ফ্রেন্চ শব্দ হয় সেটা আমার মাথায় ঢোকে না। এর মাঝে লক্ষ্য করলাম মেয়ে দুজনও দুর্বোধ্য ভাষায় কথা বলছে। সাথে সাথে মনে হলো, আরে, এরা কি তবে ফরাসী? ফরাসী তরুণী! আর যায় কোথায়? সাথে সাথে “যা আছে কপালে” জপ করতে করতে প্রশ্ন করা শুরু করলাম। কিছু বুঝতে না পারলে, এমন কি ক্ষেত্র বিশেষে বুঝতে পারলেও। এক এশিয়ান ছেলে কত আগ্রহী হয়ে ফরাসী মুভি দেখছে। এই উৎসাহকেই উদ্দীপ্ত রাখতে কিনা জানি না, তারাও আমাকে সোৎসাহে ঘটনা বোঝানো শুরু করলো। শুরু হলো মুভি দুই জায়গায়। অন স্ক্রিন এবং অফ স্ক্রিন। অন স্ক্রিনে নায়িকা একজন কিন্তু অফ স্ক্রিনে দুই জন!

প্রিয় পাঠক, মুভি চলতে থাকুক। আমরা এই ফাঁকে অন্য প্রসঙ্গে একটু কথা বলি। প্রসঙ্গ মেয়েদের হ্যান্ডব্যাগ। মেয়েরা সব সময় বড় একটা হ্যান্ডব্যাগ নিয়ে কেন ঘোরে সেটা ছিল আমার বাল্যকালের অন্যতম কৌতূহল। নিজে বড় হতে হতে সেই রহস্য ঘুচতে শুরু করে; ইউরোপ আসার পর পরিষ্কার হয়। ২৪ ঘণ্টা যদি আপনি একটা মেয়ের সাথে কাটান, দেখবেন ২৪ ঘণ্টাই তার শরীর থেকে পারফিউমের গন্ধ বের হচ্ছে। আপাতদৃষ্টিতে কথাটা জ্বালানি ছাড়া বিদ্যুৎ উৎপাদন করে নিউটনের তাপ গতিবিদ্যার প্রথম সূত্রকে ভুল প্রমান করার মত শোনায় বটে, কিন্তু ঘটনা সত্য। শাহারা মরুভুমিতে ঘুরতে যান। ঘণ্টা দুইয়েকের মধ্যে আপনার একাকার অবস্থা হয়ে যাবে। কিন্তু আপনার সঙ্গিনী তখনও ব্যাপক স্টাইলের সাথে তার সুগন্ধি ছড়ানো শরীর এলিয়ে প্রকৃতি দেখতে থাকবে। আপনি হয়তো ভাবতে পারেন এই সুগন্ধি ছড়ানোর মূল ক্রেডিট পারফিউমের কিন্তু আমি বলবো আপনি ভুল। সব ক্রেডিট আসলে হ্যান্ডব্যাগের। ঐ হ্যান্ডব্যাগে যে কত কী থাকে, খুলে না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না। বলাবাহুল্য, পারফিউম তার অন্যতম। বুদ্ধিমান পাঠক হয়তো ধরে ফেলেছেন পারফিউম বিষয়ক এত কথা কেন বলছি। হ্যা, আমার পাশে উপবিষ্ট তরুণীদ্বয়ের পারফিউমের গন্ধে তখন চারপাশ মঃ মঃ করছিল। অনেকটা যেন দুই মিটার ব্যাসের একটা বৃত্ত তৈরি করে তার মধ্যে তারা বসে ছিল। তার উপর ফরাসী পারফিউম! সবিস্তারে বলার প্রয়োজন দেখি না। আমি পঞ্চ ইন্দ্রিয়ের তিনটা ইন্দ্রিয়কে প্রবল ভাবে ব্যবহার করতে থাকি। চোখ দিয়ে মুভি দেখি, কান দিয়ে তাদের বর্ণনা শুনি, আর নাক দিয়ে পারফিউমের গন্ধ নেই। বর্ণনা শুনতে শুনতে আবার মাঝে মাঝে পাশেও তাকাই। সময়টা দারুণ কাটছিল।

এদিকে যত সময় যেতে থাকে তত একটা জিনিস উপলব্ধি করতে শুরু করি। সেটা হলো, পৃথিবীতে আকর্ষণ জিনিসটা খুব ঠুনকো। বিশেষতঃ নারীর আকর্ষণ। একদিকে মাত্র আধ ঘণ্টার মধ্যে আমি ফরাসী তরুণীদের ব্যাপারে আকর্ষণ হারিয়ে ফেলি; অন্যদিকে খুব হালকা চালে শুরু হওয়া মুভিটা হঠাৎ করে আমার দৃষ্টিকে প্রবল ভাবে আকর্ষণ করতে শুরু করে। একটা জায়গায় নায়ককে এক ফরাসী মেয়ের সাথে ইংলিশ তরুণের সম্পর্ক ভাঙতে পাঠানো হয়। নায়ক অনেক খুঁজেও ছেলেটার কোন খুঁত বের করতে পারে না। এত পার্ফেক্ট একটা ছেলের সাথে সম্পর্ক ভাঙা এক রকম অসম্ভব। শেষ চেষ্টা হিসেবে নায়ক গেলো এক দামী রেস্তোরায় যুগলের ডিনারের দিন ভিক্ষুকের ছদ্মবেশে পর্যবেক্ষণ করতে। জানালার বাহির থেকে বাইনাকুলার দিয়ে অনেক সময় দেখার পর নায়ক ছেলেটার একটা খুঁত বের করলো। সে উচ্ছিষ্ট খাওয়াগুলো প্যাক করে নিয়ে যাচ্ছিল। সেটা দেখে নায়ক আর্কিমিডিসের মত ইউরেকা স্টাইলে লাফিয়ে ওঠে। এই ইস্যুকেই ব্যবহার করে এদের সম্পর্ক ভাঙ্গা হবে বলে যখন সে ঠিক করে তখন দেখে তারা (যুগল) বের হয়ে আসছে। নায়ক দ্রুত তার ভিক্ষাবৃত্তিতে মনোযোগ দেয়। কিন্তু ছেলেটা উল্টা নায়কের দিকেই আসে। তারপর সেই উচ্ছিষ্ট খাবারের প্যাকটা ভিক্ষুক ছদ্মবেশী নায়কের হাতে দেয়। বয় ফ্রেন্ডের এই উদারতা দেখে মেয়েটা গলে যেতে থাকে আর নায়ক পাথরের মূর্তি হয়ে তাকিয়ে থাকে তাদের দিকে। ছবির ঠিক এই জায়গাটায় এসে আমি প্রবল ভাবে একটা পাঞ্চ অনুভব করি। হঠাৎ মনে হয় মুভিটা তো দারুণ ইন্টারেস্টিং। আর ঠিক সেই সময় থেকে পাশে বসা মেয়েদের আমি প্রায় ভুলেই যাই।

এরপর গোগ্রাসে গিলতে শুরু করলাম হার্টব্রেকার। অহোমান ডুহিস (Romain Duris) নামের একজন ফরাসী অভিনেতা প্রধান পুরুষ চরিত্র তথা আমাদের হার্টব্রেকার হিসেবে অভিনয় করেছে। পাতলা লিকলিকে শরীরের ডুহিস যখন হাঁটে সেটার মাঝে যেন এক ধরনের কৌতুক লুকানো থাকে যা ঠিক ভাষায় বর্ণনা করা সম্ভব না। পুরো মুভিতে তার অসাধারণ অভিনয় কেবল মুগ্ধতাই ছড়ায়। অন্য দিকে মূল নারী চরিত্রে অভিনয় করেছে ফরাসী গায়িকা এবং মডেল ভেনিসা পাগাদি (Vanessa Paradis)। নিজের ভালোবাসা থেকে নিজের অজান্তে বিচ্যুত হতে থাকা এক নারীর ভূমিকায় ভেনিসাও ছিল অনন্য। পুরো মুভিতে ডুহিস-ভেনিসার কেমিস্ট্রিটা চোখে পড়ার মত ছিল। একেবারে শেষের দিকে একটা লং ড্রাইভ এবং নাচের দৃশ্য রয়েছে যেটা আমার মনে দারুণ ভাবে দাগ কেটে যায়। ইমোশনের সাথে কমেডির অপূর্ব মিশ্রণে নির্মিত মুভিটা খুব সহজেই দর্শক হৃদয়ে স্থান করে নেয়া যোগ্যতা রাখে। শুধু দর্শক নয়, সমালোচকদেরও হৃদয়ও জয় করতে পেরেছে বেশ ভালো ভাবে। রোটেন টমাটোর ৭৭ শতাংশ ক্রিটিক্স মুভিটার পক্ষে রায় দিয়েছে। আর এভাবেই মাত্র আট মিলিয়ন ইউরো বাজেটে নির্মিত মুভিটা রিলিজের সাথে সাথে ৩৫ মিলিয়ন আয় করে নেয়। শুধু তাই না, হিট করার সাথে সাথে মুভিটার কপিরাইট যুক্তরাষ্ট্র থেকে কিনে নেয়া হয়েছে এর হলিউড ভার্সন বানানোর জন্যে। তবে সেটা আসতে সময় লাগবে। সেই ফাঁকে মূল ফরাসী ছবিটা দেখে নিলে কেউ ঠকবেন না হলফ করে বলতে পারি।

মুভি শেষ হবার পর থিয়েটার থেকে বের হয়ে আসি। এসকেলেটর দিয়ে নামতে নামতে দেখি আমার সামনে হাঁটছে সেই দুই ফরাসী তরুণী। আমাকে দেখে তাদের একজন একটু হাসি দেয়, আমিও পাল্টা হাসি। তারপর সিনেওয়ার্ল্ড থেকে বের হয়ে আসি। পেছনে ফেলে আসি অনেক অনেক দুষ্টামি আর দুই ফরাসী তরুণীকে; কিন্তু হৃদয়ে করে নিয়ে আসি হার্টব্রেকার। সেদিন সন্ধ্যায় ডাবলিনের পথে পথে হাঁটছিলাম আর ভাবছিলাম, আসলেই কি জীবনটা এমন হয়? ঠিক সিনেমার মত। হলে মন্দ হতো না। ঠিক যেভাবে হার্টব্রেকারে নায়ক নায়িকাকে বলে, “তুমি ঐ ছেলেকে বিয়ে করে ফেলো”, আমিও সেভাবে একজনকে বলেছিলাম। পার্থক্য এতটুকু, নায়িকা নায়কের কাছে ফিরে এসেছিল কিন্তু আমার জীবনের নায়িকা আসে নি।

২১ নভেম্বর ২০১০
ডাবলিন, আয়ারল্যান্ড

ব্রোকেন হার্ট তরুণ, ফরাসী তরুণীদ্বয় এবং হার্টব্রেকার

এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান