এইচ থেকে হেইচ – ভাষার বিবর্তন

আমি ইংরেজী H-কে “হেইচ” উচ্চারণ করি। এতে আমার ছোট বোনের ব্যাপক আপত্তি। তার ভাষায় এটা নাকি স্কটল্যান্ডের মানুষরা যারা একটু “নীচু প্রকৃতি”র, তারা উচ্চারণ করে থাকে। “স্ট্যান্ডার্ড ইংরেজী” অনুসারে এটা ভুল। তার কোন এক প্রফেসারকে নাকি একজন “খাঁটি” আইরিশ ভাষাবিদ “হেইচ” উচ্চারণ করতে মানা করেছে। আমার ছোট বোনের এই মন্তব্যের জবাবে সাড়ে সাত ঘণ্টা গবেষণা করে এবং কিছু ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা দিয়ে নিচের পোস্টটা তৈরি করলাম।

হেইচ” বিষয়ে আমার মনে হচ্ছে অনেকের ভুল ধারণা রয়েছে। আমি ভাষাবিদ নই, তাই ভাষার খুঁটিনাটী আমি ভালো জানি না। তবে ইতিহাস এবং ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার আলোকে বিষয়টাকে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করবো এখানে। Continue reading “এইচ থেকে হেইচ – ভাষার বিবর্তন”

এইচ থেকে হেইচ – ভাষার বিবর্তন

বাংলা নববর্ষ এবং আমাদের অজ্ঞতা

প্রশ্নটা দেশে থাকতে অনেককে করতাম। বলুন তো বাংলা প্রথমবর্ষ তথা বাংলা ১ সনে কী হয়েছিল? বেশীর ভাগ মানুষ একটু বিব্রত বোধ করতেন। কেউ কেউ উৎসাহী হয়ে বলতেন হয়তো অনুষ্ঠান বা মেলা হয়েছিল। কারো কারো অনুমান রীতিমত ‘ওয়াইল্ড গেস’-কেও হার মানাতো। কিন্তু সঠিক উত্তরটা খুব কম মানুষ দিতে পেরেছিলেন। সেটা হলো বাংলা ১ সন বলে আসলে কিছু নেই।

আজ ১৪১৬ সনের প্রথম দিন। পেছন দিকে গুনতে থাকলে একটা ১ সন আসবে, এটাই স্বাভাবিক ধারণা। সৌর বছর অনুযায়ী তৈরি গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার (আমরা যেটাকে ইংরেজী ক্যালেন্ডারও বলে থাকি) বা হিজরী ক্যালেন্ডার বা অন্য কোন ক্যালেন্ডারের ক্ষেত্রে এ কথাটা সত্য হলেও বাংলা সন ব্যতিক্রম। বাংলা ক্যালেন্ডারের সূচনাকারী সন ১ থেকে শুরু হয় নি বরং অনেকটা মাঝ থেকে হঠাৎ করে লাফ দিয়ে বাংলা ক্যালেন্ডার তার যাত্রা শুরু করেছে।

সম্রাট আকবরের সময় কৃষকদের থেকে কর আদায় করা হতো হিজরী সন অনুযায়ী। কিন্তু লুনার ক্যালেন্ডার (চন্দ্র বছর) অনুসরণ করা হিজরী সনের প্রথম দিন একেক বছর একেক সময়ে আসতো। ফলে অনেক সময় কৃষকদের ফসলহীন মৌসুমে কর দিতে হতো যা তাদের জন্য কষ্টকর হয়ে যেতো। সম্রাট আকবর এই সমস্যার সমাধান করার জন্যে সে সময়ের বিশিষ্ট পণ্ডিত ফতেউল্লাহ সিরাজীকে একটা নূতন ক্যালেন্ডার তৈরির আদেশ দেন। পরবর্তীতে ফতেউল্লাহ সিরাজী হিজরী ক্যালেন্ডার এবং গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডারের মধ্যে একটা ‘স্মুধ ট্রানজেশন’ ঘটান অর্থাৎ লুনার ধারণা অনুসরণ করা হিজরী সনকে গ্রেগরিয়ান ধারণায় রূপান্তর করেন। যদিও এই ক্যালেন্ডার প্রবর্তন করা হয় ১৫৮৪ খৃষ্টাব্দের ১০ (অথবা মতান্তরে ১১) মার্চ, তবে হিসেব গণনা করা শুরু করা হয় (ব্যাক ডেটে) ১৫৫৬ সন থেকে, যা আকবরের সিংহাসন আরোহনের সন। ঐ বছরের (১৫৫৬) হিজরী সনকে ফতেউল্লাহ সিরাজীর তৈরি করা গ্রেগরিয়ান হিসাব অনুযায়ী বাংলা বর্ষ গণনা শুরু হয়। সে হিসেবে পেছন দিকে গুনতে থাকলে বাংলা ৯৬৩ সনের আগে আর কোন সন পাওয়া সম্ভব নয়। আরেকটা বিষয় লক্ষ্য করে থাকবেন হয়তো পাঠক, বাংলা সন এবং হিজরী সন খুব কাছাকাছি বিরাজ করছে। বর্তমানে ১৪৩০ হিজরী সন চলছে এবং বাংলা শুরু হলো ১৪১৬। আজ থেকে ৪৫৩ বছর আগে ৩৫৫ দিনের (প্রায়) হিজরী সনকে ৩৬৫ দিনের (প্রায়) বাংলা সনে রূপান্তর করা হয়। ফলে অতিরিক্ত ১০ দিনের কারণে বাংলা সন ১৩ বছরের বেশী পিছিয়ে গিয়েছে হিজরী সন থেকে (453×10 = 4530। 4530/365 = 12.41)। তাছাড়া বাংলা সন সব সময় গ্রেগরিয়ান/ক্রিস্চিয়ান ক্যালেন্ডার থেকে ৫৯৩ বছর পিছিয়ে থাকবে। সেজন্যে বর্তমানে কত বাংলা সন চলছে সেটা জানার সবচেয়ে কার্যকরী উপায় হলো গ্রেগরিয়ান সন থেকে ৫৯৩ বিয়োগ করা।

এখানে একটা বিষয় উল্লেখ করা প্রয়োজন যে বাংলাদেশে পহেলা বৈশাখ সব সময় ১৪ এপ্রিল পড়ে; কিন্তু ভারতে সেটা কখনও ১৪ আবার কখনও ১৫ এপ্রিল অনুষ্ঠিত হয়। এর কারণ বাংলাদেশে যে বাংলা ক্যালেন্ডার অনুসরণ করা হয় সেটাকে ১৯৬৬ সনের ১৭ই ফেব্রুয়ারী ড. মোহাম্মদ শহীদুল্লার নেত্রীত্বে গঠিত বাংলা একাডেমীর একটা কমিটি সংশোধন করেছিলেন। তখন বাংলা ক্যালেন্ডারে কোন লিপ ইয়ার ছিল না। ফলে গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডারের সাথে বাংলা ক্যালেন্ডারের একটা অসামঞ্জস্যতা সৃষ্টি হতো। সেই কমিটি ক্যালেন্ডারটিকে সংশোধন করে মাসের দিনগুলো পুনঃনির্ধারন করেন এবং গ্রেগরিয়ান লিপ ইয়ারের বছরে ফাল্গুন মাসে একটা অতিরিক্ত দিন যোগ করে দিন সংখ্যাকে ঠিক রাখার প্রস্তাব দেন। পরবর্তীতে ১৯৮৭ সন থেকে বাংলাদেশে এই ক্যালেন্ডারটি অনুসরণ করা হচ্ছে যদিও ভারতে সনাতন ক্যালেন্ডার মেনে এখনও নববর্ষ পালন করা হয়। তাছাড়া ভারতে আকবরীয় ধারণার বিষয়টাকে বাংলা নববর্ষের প্রকৃত ইতিহাস হিসেবে মানা হয় না বরং রাজা শশাঙ্কের সময়ের (যার শাসনকাল ছিল ৫৯০ থেকে ৬২৫ খৃষ্টাব্দের মাঝামাঝি) ইতিহাসকে তারা বাংলা ক্যালেন্ডারের ইতিহাস মনে করে। মজার বিষয় হলো সেই ইতিহাস অনুযায়ী বাংলা নববর্ষের সূচনা ১৪ এপ্রিল ৫৯৪ খৃষ্টাব্দ, যা বর্তমান ক্যালেন্ডারের সাথে হুবাহু মিলে যায়। অন্যদিকে আকবরীয় ইতিহাসে সূচনাকারী দিনটি একটা বড় ত্রুটি।

আরেকটি বিষয় এখানে একটু ব্যাখ্যা করার প্রয়োজন বোধ করছি। প্রতি বছর বাংলা নববর্ষের সময় রাত ১২টা ১ মিনিটে মানুষ নববর্ষের শুভেচ্ছা জানায়। এই রীতিটা সম্পূর্ণ ভুল। গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার অনুযায়ী দিন শুরু হয় রাত ১২টার পর থেকে কিন্তু বাংলা ক্যালেন্ডার অনুযায়ী দিন শুরু হয় সূর্যোদয়ের পর। ঠিক যেমনটা হিজরী ক্যালেন্ডারে দিন শুরু হয় সূর্যাস্তের পর থেকে। ফলে নববর্ষের শুভেচ্ছা জানানো উচিত সকালে সূর্যোদয়ের সময়। বিষয়টা আপাতদৃষ্টিতে খুব সাধারণ মনে হলেও আমরা আসলে দিনের পুরো এক চতুর্থাংশ তথা ছয় ঘণ্টার হেরফের করে ফেলছি। তাছাড়া শুভেচ্ছা যখন বাংলা নববর্ষের জানাচ্ছি তখন এই সামান্য অজ্ঞতাটুকু থেকে বের হয়ে আসতে দোষ কোথায়? আগামী বছর যদি লন্ডনের বা সিডনীর বিখ্যাত বর্ষ বরণ ফায়ারওয়ার্কস সন্ধ্যা ছয়টায় করা হয় সেটা কি হাস্যকর হবে না? আমাদের নববর্ষ বিশ্বব্যাপী সুপরিচিত নয় বলে কি আমরা একটা ভুল রীতিকেই অনুসরণ করে যাবো? তাহলে ভিনদেশীরা আমাদের থেকে সঠিকটা শিখবে কি করে? তাছাড়া বিশ্বব্যাপী সুপরিচিত নয় কথাটাও সম্ভবত ঠিক নয়। লন্ডনে অনুষ্ঠিত বাংলা নববর্ষের অনুষ্ঠান পুরো ইউরোপে অনুষ্ঠিত সর্ব বৃহৎ এশিয়ান ফেস্টিভেল এবং বাংলাদেশ ও ভারতের বাহিরে সর্ব বৃহৎ বাঙালী অনুষ্ঠান। ফলে আমাদের এই চর্চাগুলো হওয়া উচিত নির্ভুল যাতে আমাদের পরবর্তী বংশধর এবং ক্ষেত্রে বিশেষে ভিনদেশীরাও আমাদের থেকে সঠিকটা দেখতে এবং শিখতে পারে।

আসুন, আমরা আমাদের অজ্ঞতাগুলো ঝেড়ে ফেলে নিজের সংস্কৃতি ও ইতিহাসকে জানার চেষ্টা করি এবং আগামী বছর থেকে সকালের সূর্যোদয়ের পর সবাইকে নববর্ষের শুভেচ্ছা জানাই। আপনার জীবনে নববর্ষ বয়ে আনুক নূতন সুখ এবং সমৃদ্ধি। সবাইকে নববর্ষের শুভেচ্ছ – শুভ নববর্ষ।

১৪ এপ্রিল ২০০৯ / পহেলা বৈশাখ ১৪১৬ (বাংলাদেশ সময়)
ডাবলিন, আয়ারল্যান্ড।

বাংলা নববর্ষ এবং আমাদের অজ্ঞতা