তরল – ৩ (শারদদা সিরিজের গল্প)


পরদিন সন্ধ্যায় ইন্সপেক্টার জেমস সহ আমি আবার বসলাম সেই রুমে। সাথে আমার বলে দেয়া সেই চার ব্যাক্তি – অ্যালবার্ট, মার্ক, জেনিফর এবং ড্যানিয়েল। আমি আড় চোখে তাকিয়ে দেখলাম ড্যানিয়েল কেমন যেন ছটফট করছে। মার্ক এবং জেনিফার বেশ শান্ত। রেস্টুরেন্টের মালিক অ্যালবার্টকে কিছুটা দ্বিধান্বিত মনে হলো। আমি এবং জেমস ছাড়া অন্যরা তখনও এই মিটিং-এর বিষয়টা দেখে বেশ অবাকই হচ্ছিল, যদিও আমি জানতাম অন্তত একজন আছে এখানে যে অবাক হচ্ছে না বরং অবাক হবার ভান করছে।

যাইহোক, এরপর আমি পুরো বিষয়টা অন্যদের বোঝার সুবিধার জন্য আবার বললাম। প্রোপাইলেন গ্লাইকল মনোমিথাইল ইথার থেকে শুরু করে ব্ল্যাক লাইট এবং সেই নীল আলো, কিছুই বাদ দিলাম না। অ্যালবার্ট সব শুনে আকাশ থেকে পড়লো। যেন বিশ্বাসই করতে পারছিল না এটা সম্ভব হয় কি করে। অন্যরাও নিজেদের মধ্যে নিচু স্বরে কথা বলতে শুরু করলো।

এদিকে আমার ধীর গতির বর্ননা শুনতে শুনতে জেমস অস্থির হয়ে উঠছিল। সম্ভবত আর সাসপেন্স সহ্য হচ্ছিল না। তাই সে অসহিষ্ণু ভাবে লকার খোলার বিষয়টা ব্যাখ্যা করতে বললো। এবার আমি উঠে লকার প্যাডের ডালাটা খুলে প্যাডের উপর আবার ব্ল্যাক লাইটটা ফেললাম। যথারীতি আজও তিনটা নীল আলো জ্বলে উঠলো। আমি জ্বলজ্বল করা নাম্বারগুলো জেমসকে দেখিয়ে বললাম, এখানে তিনটা দাগের কারণ আমি একটা নাম্বার দুবার চাপ দিয়েছি। যদি চারটা ভিন্ন ভিন্ন সংখ্যা ব্যবহার করতাম তাহলে মূল কম্বিনেশনটা বের করা চোরের জন্য তুলনামূলক ভাবে সহজ হতো কারণ তাহলে মাত্র ২৪টা কম্বিনেশনের ভেতর থেকে তাকে অনুমান করতে হতো। কিন্তু এখন কাজটা হয়ে গেলো একটু জটিল। তাকে ৭২টা কম্বিনেশনের ভেতর থেকে খুঁজে বের করতে হয়েছে আসলটাকে; অর্থাৎ ১,৭ এবং ৯-কে আলাদা ভাবে দুইবার করে ব্যবহার করে কম্বিনেশনটা সাজাতে হয়েছে। বলে রাখা ভালো লকারে পরপর পাঁচবার ভুল কম্বিনেশন প্রবেশ করালে পরবর্তি ১২ ঘন্টার জন্য এটা লক হয়ে থাকে। অতএব অনুমান করতে হলে তাকে সর্বোচ্চ পাঁচ বারের মধ্যে অনুমান করতে হতো, এটা হয়তো চোর জানতো। জেমস বললো, এই ৭২টা কম্বিনেশন হাতে সাজানোওতো অনেক সময়সাপেক্ষ এবং ধৈর্যের ব্যাপার। আমি আবারও হেসে বললাম এটা ঠিক যে কাজটা বেশ সময়সাপেক্ষ। কারণ তাকে অনেকটা এভাবে বের করতে হয়েছে: ১৭৯৯ ১৯৭৯ ৯১৭৯ ৯৭১৯ এভাবে ৭২টা কম্বিনেশন সাজিয়ে তারপর সে অনুমান করেছে সম্ভাব্য পাঁচটা কম্বিনেশনকে। আমার ধারনা এটা হাতে করা হয়নি। জেমস জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালো। আমি জানালাম যেই এটা করেছে সে কম্পিউটার ব্যবহার করতে পারে। একটা ছোট সি-প্রোগ্রাম ৭২টা সম্ভাব্য কম্বিনেশন এক সেকেন্ডেরও অনেক কম সময়ে তৈরী করে দিতে সক্ষম। সাথে একটা ল্যাপটপ থাকলে এটা কোন ব্যাপারই না।

এরপর বাকি থাকলো অনুমানের বিষয়টা। এটা করার জন্য সে আমাকে খুব ভালো করে পর্যবেক্ষণ করেছে। আমি কিভাবে চিন্তা করি, কী কী বিষয়কে গুরুত্ব দেই, আমার আবেগ-অনুভুতি ইত্যাদি তাকে খুব ভালো করে জানতে হয়েছে। লকারের কম্বিনেশন নাম্বার হলো ১৯৭১। এটা যে আমার কাছে শুধুই একটা সন নয়, সেটা আমার সাথে যারা নিয়মিত ইতিহাস এবং রাজনীতি নিয়ে কথা বলে তারা সহজেই অনুমান করতে পারবে। ৭২টা কম্বিনেশনের মাঝে চোর যখন ১৯৭১-কে দেখবে, তখন অবধারিত ভাবেই এটাকে সে ব্যবহার করবে।

“আর লকার রুমের মূল দরজা খোলার বিষয়টা?” জেমস উত্তেজিত ভাবে জিজ্ঞেস করলো।

আমি হেসে বললাম সেটা আসলে খোলাই হয়নি। লকার রুমের দরজাটা রেস্টুরেন্ট বন্ধ করার আগ পর্যন্ত খোলাই থাকে। যে চুরি করেছে সে আগে থেকে রুমের ভেতরে ঢুকে পরিত্যাক্ত টয়লেটটায় লুকিয়ে ছিল। আমি সবার শেষে রেস্টুরেন্ট তালা দিয়ে চলে যাওয়ার পর সে বের হয়ে এসে চুরিটা শেষ করে। তারপর প্রথমে লকার রুমের দরজা খুলে বের হয়ে আসে, এরপর রেস্টুরেন্টের পেছনের দরজা দিয়ে চলে যায়। সেই দরজাটাও বাহির থেকে টান দিলেই আটকে যায়।

আমার ব্যাখ্যা শুনে জেমসের চোখ আরো উজ্বল হয়ে উঠলো। বলল, তাহলেতো দোকানেরই কেউ সম্ভবত কাজটা করেছে। আমিও মাখা নেড়ে সম্মতি জানালাম। রেস্টুরেন্টের কেউ ছাড়া আমার ব্যাপারে এতটা গভীর ভাবে জানা খুবই কঠিন। আমি বাইরে খুব একটা মেলামেশা করি না। তাছাড়া এত পরিকল্পিত ভাবে বাহিরের মানুষের পক্ষে চুরি করা সম্ভব নয়। আতএব রেস্টুরেন্টেরই কেউ কাজটা করেছে সে বিষয়ে আমি মোটামোটি নিশ্চিত।

আমার কথা শেষ হওয়ার সাথে সাথে একটা চাঁপা গুঞ্জন উঠলো রুমে। ড্যানিয়েল কি যেন বলতে যাচ্ছিল। জেমস ওকে থামিয়ে দিয়ে বললো এখনও কাউকে সুনির্দিষ্ট ভাবে অভিযুক্ত করে আমি কিছু বলিনি। অতএব উত্তেজিত হবার কিছু নেই। তাছাড়া জেমসের সাথে করে আনা দুই শার্দূল আকৃতির পুলিশ অফিসারকে দেখেও রুমের অন্যরা কিছুটা শান্ত হলো।

এবার আমি রেস্টুরেন্টের মালিক অ্যালবার্টের দিকে তাকালাম। আমার তাকানোর ভঙ্গি দেখে অ্যালবার্ট একটু অপ্রস্তুত হয়ে গেলো। আমি হেসে বললাম অ্যালবার্ট তোমাকেও হিসেব থেকে বাদ দেয়া যায় না কেননা এই চুরি দুই দিক দিয়ে তোমাকে লাভবান করে। চুরিরটাতো আছেই, সাথে ইন্সুরেন্সের ক্ষতিপূরণ। আমরা চলে যাওয়ার পর রাতে ফিরে এসে লকার খোলার সূবর্ণ সুযোগ ছিল তোমার কাছে।

অ্যালবার্ট আত্মপক্ষ সমর্থন করে কিছু বলতে যাচ্ছিল। তাকে আমি ইশারায় থামিয়ে বললাম আমার এখনও বলা শেষ হয়নি। আমার শেষ হলে সবাইকেই আমি বলার সুযোগ দেব। তারপর জেমসকে জানালাম এই সম্ভাব্য চার থেকে একে একে তিনজনকে বাদ দিয়ে একজনে নেমে আসার জন্য আমি সকাল থেকে কিছু তদন্ত করেছি যা আমাকে একটা স্বীদ্ধান্তে পৌছাতে সাহায্য করেছে। জেমস কিছু বললো না। শুনতে লাগলো।

জেমসকে জানালাম আমার ধারণা ছেলেদের কেউ চুরিটা করেছে কারণ জেনিফার কম্পিউটারে খুব একটা পারদর্শি নয়। গনিতেও সে বেশ কাঁচা। তার দ্বারা এই কাজ কোন দিনও সম্ভব না। তাছাড়া আমার জানামতে মার্ক এবং ড্যানিয়েলের ল্যাপটপ রয়েছে যা তারা রেস্টুরেন্টে মাঝে মাঝে নিয়ে আসে। আর অ্যালবার্ট সবসময় সাথে ল্যাপটপ নিয়ে ঘোরে। অতএব প্রথমে এই তিনজনের প্রতি আমার সন্দেহ ঘনিভূত হয়। এরপর খোঁজ নিয়ে দেখি অ্যালবার্ট সেদিন রাতে কোথায় ছিল। আমাদের সে বলেছিল লন্ডনে টেমসের পাড়ে ফায়ারওয়ার্কস দেখতে যাবে স্বপরিবারে। কথাটা মিথ্যাও হতে পারতো। তবে আমি খোঁজ নিয়ে নিশ্চিত হয়েছি সে থার্টিফার্স্ট নাইট এবং জানুয়ারির প্রথম দিন লন্ডনেই ছিল।

এবার সবার দৃষ্টি দলে গেলো মার্ক এবং ড্যানিয়েলের দিকে। ওরা দুজনও আমার দিকে বড় বড় করে তাকিয়ে রইলো। আমি ওদের দৃষ্টিকে উপেক্ষা করে অনেকটা হাসতে হাসতেই পকেট থেকে একটা কাগজ বের করে টেবিলে রাখি। বয়েলস্পোর্টস বেটিং এ্যাজেন্সির প্যাডে লেখা কিছু হিসেব। আমি যখন হাসছিলাম তখন ওদের দুজনের একজনের চোখে হতাশা লক্ষ্য করলাম কারণ সে বুঝে ফেলেছে আমি চুরির আসল মোটিভ খুঁজে বের করে ফেলেছি। তারপর জেমসকে বললাম আমাদের রেস্টুরেন্টের ঠিক সামনেই যে বাজি ধরার বুথটা আছে ওখানে খোঁজ নিয়ে জানতে পারি এই দুই রত্নের এক রত্ন প্রায় ২৩০০ পাউন্ড বাজি হেরেছে কিছু দিন আগে। যদিও বয়েলস্পোর্টস থেকে ওরা তথ্য দিতে চায়নি, তবে একজন স্টাফের পকেটে বিশ পাউন্ড ঢুকিয়ে দেয়ার পর তথ্যগুলো সহজেই বের হয়ে আসে। এছাড়াও চোর স্বয়ং চোরের ফাঁদেই পা দিয়েছে। ধরা যে তাকে পড়তেই হবে।

মানে বুঝতে না পেরে জেমস আমার দিকে তকিয়ে রইলাম। আমি হাসতে হাসতে বললাম, নোটগুলোতেও আমার হাত থেকে সলিউশনটা লেগেছে। অতএব ঘর সার্চ করে যে নোট পাওয়া যাবে, সেগুলোতে ব্ল্যাক লাইট দিয়ে পরীক্ষা করলে সম্ভবত এখনও কিছু নোট জ্বলবে। তারপর মার্কের দিকে তাকিয়ে বললাম, “কি বলো তুমি। জ্বলবে না?”। জেমসকে একটু খোঁচা দিয়ে সাথে যোগ করলাম, “না জ্বললেও সমস্যা নেই। ইন্সপেক্টার জেমসের অপরাধ স্বীকার করানোর একশ একটা উপায় জানাই আছে!”

বলাইবাহুল্য চুরিটা মার্ক করেছিল। শেষ পর্যন্ত ওর বাসা থেকেই নোটগুলো উদ্ধার হয়। চাপে পড়ে অপরাধও স্বীকার করতে বাধ্য হয় সে। মেধা ছিল তার কিন্তু বদস্বভাবও কম ছিলনা। ক্রিকেটের বেটিং-এ অনেক টাকা হেরে তার আর্থিক অবস্থা বেশ খারাপ যাচ্ছিল। হয়তো সেজন্যই চুরি করাটা জরুরী হয়ে পড়েছিল। জুয়া জিনিসটাই এমন, যাকে একবার ধরবে শেষ করে ছাড়বে। মেধা থাকা স্বত্ত্বেও মার্ককে তাই জীবনের স্বর্নসময়টুকু জেলের অন্ধকারে কাটাতে হলো।”

শারদদা যখন থামলেন তখন ঘরে পিনপতন নিরবতা। একটু পর রায়হান জিজ্ঞেস করলো, “শারদদা, আপনি কি এরপরও স্কটল্যান্ড ছিলেন?”

স্মৃতি রোমান্থনে বিভোর শারদদা জবাব দেয়, “থাকতে পরতাম। তবে মন আর টানলো না। তাই পরের মাসে অস্ট্রিয়া চলে যাই।”

এরপর খানিকক্ষণ চুপ থেকে যেন নিজেই নিজেকে প্রশ্নটা করেন, “কিন্তু সেখানেও কি আর শান্তি পেলাম?”

“কেন? কেন?” রায়হান আবারও উৎসুখ হয়ে উঠে।

তবে সেদিকে তখন আর শারদদার নজর নেই। ডালপুরির প্লেট খালি হয়ে যাওয়াতে মেজাজ মনে হয় একটু বিগড়ে গিয়েছিল। তাই ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে ছিলেন আমাদের দিকে। ইঙ্গিতটা ইদ্রিসের জন্য যথেষ্ট ছিল। বিনাবাক্য ব্যয়ে সে তাই দৌড় দিল ফরিদের দোকানের উদ্দেশ্যে। (সমাপ্ত)

৯ ডিসেম্বর ২০০৯

ডাবলিন, আয়ারল্যান্ড

তরল – ৩ (শারদদা সিরিজের গল্প)

এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান