ডাবলিনের ডায়েরী – ১৫ (৫ মে ২০০৯)


রাত তিনটার মত বাজে। কিন্তু সেই পুরোনো সমস্যা। ঘুম আসছে না। রুটিন পুরোপুরি এলোমেলো হয়ে গিয়েছে। জীবন নামের ট্রেনটাকে আবার লাইনে তুলতে যে কত ঝামেলা পোহাতে হবে, খানিকটা বুঝি। তবে সেটা যে কবে, সেটাই কেবল বুঝি না।

সামার আগত কিন্তু প্রকৃতিতে সেটা প্রতিফলিত হচ্ছে না। দিনের বেলা খানিকটা গরম পড়ে বটে, তবে সেটা সামার হিসেবে কতটা গ্রহনযোগ্য সেটা প্রশ্নসাপেক্ষ। তবে হ্যা, তরুনীদের পোশাকের ক্ষুদ্রতা মাঝে মাঝে মনে করিয়ে দেয় যে সত্যিই সামার এসে গিয়েছে। ঠিক এই মূহুর্তে বেশ ঠান্ডা পড়ছে। বঙ্গবাজার থেকে কেনা মোটা ওভারকোট গায়ে দিয়ে বসে বসে ডায়েরী লিখছি। ডায়েরী বলা বোধয় ঠিক হবে না। কেননা আমি যখন কিছু লিখি, সাধারনত একটু ভেবে নেই কি লিখবো। একটা প্রাথমিক খসড়া আমার মাথায় থাকে। কিন্তু আজ কি লিখবো, কিছুই মাথায় নেই। পুরোপুরি ফাকা। বসে বসে ঝিমাতে আর ভালো লাগছিলো না, অতঃপর ডায়েরী নিয়ে বসা।

কথায় বলে অলস মস্তিষ্ক শয়তানের আড্ডা। হয়েছেও তাই। কাল নাফিস সহ পরিকল্পনা করলাম নাইট আউটে বের হবো। টেম্পেল বার বলে একটা এলাকা আছে ডাবলিনে। খুবই জনপ্রিয়। আমাদের বেইলী রোডের মত। শিল্প-সংকৃতির প্রান কেন্দ্র। তবে রাতের বেলা সেটা হয়ে উঠে মিনি লাসভেগাস। নাইট ক্লাব, ল্যাপ ড্যান্স বার, সাধারন বার আর অন্যান্য আজব মানুষের ভীড়ে ‘তিল ঠাই আর নাহিরে’ অবস্থা হয় এলাকাটার। রাতে সিনেওয়ার্ল্ডে একটা সিনেমা দেখে সাড়ে দশটার দিকে নাফিস সহ গেলাম। বেশ কিছু নাইটক্লাব ঘুরে একটায় গিয়ে ঢুকলাম। এটা ফ্রি ছিল না। ঢোকার সময় দশ ইউরো করে রাখলো। তবে বুঝলাম বেশ জমজমাট হবে রাতে। তখনও নাকি রাত হয়নি। এক বাউন্সারকে জিজ্ঞেস করলে জানালো উপরের ড্যান্স ফ্লোর খুলে দেবে একটু পরে। কি আর করা, দুটা গিনিজের বিয়ার হাতে নিয়ে ক্যাবলার মত বসে রইলাম।

হঠাৎ কিছু ব্রোশিয়র চোখে পড়লো। তাতে লেখা ‘গে এন্ড লেসবিয়ান স্পেশাল’। তখন বুঝলাম আমি ঢোকার সময় মেইন গেটের লোকটা কেন বলেছিল “গে স্পেশাল আছে – ইনজয়!” নাফিসকে দেখালে সেও হাসলো। বললাম পরবর্তিতে আর দুইজন আসবো না। অন্তত তিনজন আসবো।

তখনও বসে আছি। সামনে টাল হয়ে বা না হয়ে কিছু মেয়ে নাচছে। মোটা মেয়েরা নাচলে যে কত আজব লাগে সেটা দেখছিলাম। এক ছেলে আরেকজনের গার্লফ্রেন্ডকে এসে নাচার অফার দিতেই সেই মেয়ে নাচতে শুরু করলো। মনে মনে হাসলাম। তারপর টেক্সট করলাম সৈকত ভাইকে – “গুরু! বেয়াক্কেলের মত বসে আছি। কি করবো এ্যাডভাইজ দেন।” একদিন আগেই তিনি আমাদের শিক্ষা দিয়েছিলেন ‘কি করে নাইট আউট করতে হয়’। তবে সেই শিক্ষার আমরা সুফল তুলতে পারছিলাম না। গুরু দ্রুত রিপ্লাই দিলেন – “গো। ট্রাই টু টক টু গার্লস। ডোন্ট বি শাই। এক্সপেক্ট নাথিং। জাস্ট টক।”

নাফিসকে দেখালাম গুরুর টেক্সট। কিন্তু সমস্যা হলো, মেয়ে পাই কোথায়। কোনটা যে সিঙ্গেল আর কোনটা মিঙ্গেল, সেটাই বুঝি না। পরে দেখা যাবে বয়ফ্রেন্ডের পাঞ্চ খেয়ে চোয়ালের দাত ওলট-পালট হয়ে যাবে। যাইহোক, পরিকল্পনা করলাম আরেকটু অপেক্ষা করবো। রাত গভীর হলে মেয়েরা আসবে, তখন নাচের সঙ্গী পাওয়া যাবে। হাতে সিল দেয়া ছিল। অন্য কিছু বারে ঘুরে এসে আবার সিকিউরিটিকে সিলটা দেখাতেই তারা হেসে ঢোকার পথ করে দিল। দশ ইউরো দামের সিল। ভাবই আলাদা। পুরো ছেলেমানুষী কাজ-কারবার করছি তখন। ওহ! বলতে ভুলে গিয়েছি। প্রথমবারতো এক বারে নাফিসকে ঢুকতেই দেয় নাই। আইডিতে বয়স না দেখালে ঢুকতে দিবে না। আমি যতই বলি সে পিহেইচডি করছে, তাতে বাউন্সারের মতের কোন পরিবর্তন হয় না। পরে বয়সের প্রমান দেখিয়ে বেচারাকে ঢোকানো হয়।

রাত এগারোটা পার হবার পরও মানুষের, বিশেষত তরুনীদের ভীড়টা আশানরুপ বাড়ছিল না। নাফিসকে বললাম আমার শেষ ট্রেন ১১.৫০-এ। এটা মিস করলে খবর আছে। নাফিস তখন ডেসপারেট। বলে, “আপনি থাকেন। আপনার টেক্সি ভাড়া আমি দেব।” আমি বললাম নাইট ক্লাবতো পালিয়ে যাচ্ছে না। আমরা স্টুডেন্ট ডিসকাউন্টের দিন আবার আসবো। আজ চলো, অন্য দিন নাইট লিঙ্ক (রাতের বাস) এর রুট দেখে আসবো। তাহলে সারা রাত থাকা যাবে। দেখলাম নাফিসের মনে ধরে নাই কথাটা। আরো কিছুক্ষন বসে রইলাম। তারপর একসময় নাফিসই বললো, চলেন। সাথে সাথে উঠে পড়লাম। আমার তখন মাথায় একটাই চিন্তা। এন্টিবায়েটিক খাওয়া হয় নাই। নাইট ক্লাবে গিয়ে শয়তানী করছি, এটা তবুও সায়মা মানতে পারবে, কিন্তু ওষুধ খাই নাই, এটা শুনলে বিয়ের আগেই তালাক।

নাফিসকে বাস স্টপেজে নামিয়ে দিয়ে আমি তারা স্ট্রিট ডার্ট স্টেশনে গিয়ে বেশ খানিক সময় বসে রইলাম। কিন্তু সময় আর কাটে না। স্টেশনের সব বিজ্ঞাপন পড়ে ফেললাম। কিন্তু তাতেও মনে হয় খুব বেশি হলে ১৫ মিনিট গিয়েছিল। ঠান্ডাটা তখন বেশ লাগছে। সৈকত ভাইকে ফোন দিলাম। সম্ভবত ব্যস্ত ছিলেন, তাই ধরলেন না। এবার পড়া শুরু করলাম ট্রেনের টাইম টেবল। সাতদিন ট্রেন কোথায় কোথায় যায়, এবং কখন কখন যায়। সব পড়ে ফেললাম। কিন্তু তাতেও সময় কাটে না। আরে ধুর। শেষ পর্যন্ত পানি কিনে খাওয়া শুরু করলাম। এরকম বিরক্তিকর সময় নিকট অতীতে আর কাটিয়েছি বলে মনে পড়লো না। যাইহোক, ১১.৫০-এ ট্রেন আসলো। দ্রুত উঠে ঠান্ডা থেকে নিজেকে বাঁচালাম। কিন্তু ট্রেনে উঠে দেখি আরেক ঝামেলা। মাতাল হয়ে থাকা কিছু ছেলে ঝগড়া করছে। এদের এই এক আজব ব্যাপার। টাল হলে কোন খবরই থাকে না কোথায় আছে, কি করছে। আমার স্টেশনে আসার সাথে সাথে নেমে পড়লাম। ঝামেলা থেকে বেঁচেছি, এই শান্তি।

বাসার দরজার ঠিক সামনে আসার পর সৈকত ভাইয়ের ফোন আসলো। ফোনে তিনি আমাদের অবস্থা শুনে হাসছিলেন আর অন্য দিক থেকে নদী (ওনার স্ত্রী) বলছে, “নিয়াজ ভাই। আপনার গার্লফ্রেন্ড আছে। আর আপনি ল্যাপ ড্যান্স ক্লাবে গিয়েছেন? দাড়ান না আমি ফেইসবুকে সব লিখবো।” আমি দ্রুত কারেকশন করে দেই, “না, না। ল্যাপ ড্যান্স না। নাইট ক্লাব।” সৈকত ভাই তখনও হাসছেন আর নদী ঝাড়ি দিয়েই যাচ্ছে!

৫ মে ২০০৯
ডাবলিন, আয়ারল্যান্ড।
ডাবলিনের ডায়েরী – ১৫ (৫ মে ২০০৯)

এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান