ডাবলিনের ডায়েরী – ১৪ (২৯ এপ্রিল ২০০৯)


আনেক রাত এখন। ঘড়ি জানাচ্ছে দুটার উপরে বাজে। চারদিকে এক অদ্ভুত নিরবতা। কেউ জেগে আছে বলে মনে হয় না। জাগার কথাও না। উইকএন্ড হলে একটা কথা ছিল; এরকম সপ্তাহের মাঝে রাত দুপুরে জেগে কারো ডায়েরী লেখার সময় নেই। তাহলে আমার কেন সময় হচ্ছে? সম্ভবত নিয়তী এটাই চাচ্ছে, সেজন্য। আসলে গত একমাস আমি এভাবেই কাটাচ্ছি। অদ্ভুত একটা সময়ের ভেতর দিয়ে যাচ্ছি এখন। অনুভুতিটাকে ঠিক লিখে প্রকাশ করা সম্ভব নয়। অনেকটা এরকম – কারো চোখ বেঁধে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। সে জানে না কোথায় যাচ্ছে, আদৌ কি করা হবে তাকে। মেরে ফেলবে? নাকি বাঁচিয়ে রাখবে। তার ভালোর জন্য নিয়ে যাচ্ছে নাকি কোন অশুভ সংকেত! কিছুই বোঝা যাচ্ছে না।

গত ২৫ মার্চ এক সাথে ইংল্যান্ড এবং স্কটল্যান্ড এর তিনটা বিশ্ববিদ্যালয়ের ঋনাত্বক বার্তা পিএইচডি করতে বৃটেন যাওয়ার স্বপ্ন ভেঙ্গে দেয়। হতাশা থেকে নিজেকে খানিকটা গুছিয়ে নেয়ার পর যুক্তরাষ্ট্র এবং কানাডায় আবেদন করার পরিকল্পনা করি। কিন্তু পরবর্তি সেশন ২০১০ সনের অক্টোবরে। এত দির্ঘ্য বিরতীর কথা ভাবলেও হতাশা আবার ঘিরে ধরে। স্কটল্যান্ডে সেপ্টেম্বর সেশন ধরার একটা সুযোগ আছে, কিন্তু সেটার কোন নিশ্চয়তা নেই। আমার অত্মবিশ্বাস এতটাই কমে গিয়েছে যে আমি সময় থাকার পরও অস্ট্রেলিয়াতে আবেদন করিনি। কারন সেই একই, আত্মবিশ্বাস। লন্ডনের কুইনমেরীর এক প্রফেসার খুব খুশি হয়েছিল আমার সিভি দেখে। তিনি জানিয়েছিলেন তার হাতে বেশ কিছু ফান্ড আছে যা তিনি আমাকে দিতে আগ্রহী। কিন্তু সেটা সিগনাল প্রসেসিং-এ। আমার ক্ষেত্র ওয়্যারলেস কমিউনিকেশনস। তবুও আগ্রহী হয়ে তাকে জানিয়েছিলাম আমি আসতে চাই। কিন্তু আমার সুপারভাইজার ড. স্টিফান ওয়েবার এক বাক্যে না করে দিলেন। তার কথাটা অনেকটা এমন ছিল – “ট্রিনিটি থেকে মাস্টার্স করে পিএইচডি অন্তত কুইনমেরীতে নয়”। নিজেও ভেবে দেখলাম, বিষয়টা উপর থেকে নিচে নামা হয়ে যায়। লন্ডনে পড়ার খুব শখ ছিল। কিন্তু সেটার জন্য এতটা ত্যাগ স্বীকার করলে ক্যারিয়ারের ক্ষতি হবে। অতঃপর আমি আইরিশ সরকারের কাছে আবেদন জানাই আমার মাস্টার্সের স্কলারশীপকে পিএইচডি পর্যন্ত বাড়িয়ে দিতে যাতে আমি ট্রিনিটি থেকে পিএইচডি শেষ করতে পারি। সেই আবেদনের একমাস পেরিয়ে গিয়েছে পরশু দিন কিন্তু কোন উত্তর আজও পাইনি। তিনটা মেইল করেছিলাম ওদের, একটারও রিপ্লাই দেয়নি। শেষটায় এটা উল্লেখ্য করেছিলাম যে দরকার পড়লে জানিয়ে দাও আবেদন গৃহীত হয়নি, কিন্তু এই মানসিক চাপ থেকে আমাকে মুক্তি দাও। তারও কোন জবাব আসেনি। আমার এসব পাগলামী দেখে স্টিফান গত শুক্রবার ছোটখাটো একটা ঝাড়ি দিয়েছে। বলেছে পরবর্তিতে আমি যেন আর কোন মেইল না করি। এ সপ্তাহে কোন জবাব না আসলে সে নিজে যোগাযোগ করবে।

যাইহোক, এরকম একটা মূহুর্তে অবাক করা একটা বিষয় জানলাম। তা হলো জীবন থেমে থাকে না। যেখানে আমি আয়ারল্যান্ড থাকবো কি থাকবো না সেটারই কোন ঠিক নেই, সেখানে আমি নুতন বাসায় উঠছি! আমি বর্তমানে যাদের সাথে বাসা শেয়ার করি, তাদের চাকরী চলে গিয়েছে রিসেশনের কারনে। ওরা হাঙ্গেরী ফিরে যাবে মের ছয় তারিখ। আমাকে তাই এর মাঝে নুতন বাসা খুঁজে নিতে বলেছিল। আমি প্রথমে একটু ভেঙ্গে পড়ি, কিন্তু পরে ঠিকই একটা চমৎকার বাসা খুঁজে বের করি। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়নের এক পিএইচডি ছাত্রীর সাহায্যে বাসাটা পাই। ডাবল রুম, রীতিমত ফুটবল খেলার মাঠ। যোগাযোগও খুব ভালো। ডাবলিনের স্কাইরেইল, ডার্ট বাসার কাছ থেকেই ছাড়ে। অন্য প্রান্তের স্টেশনটা অনেকটা আমাদের কম্পিউটার সায়েন্স ডিপার্টমেন্টের উপরে। ফলে রাত করে যাওয়া আসা করাতেও সমস্যা হবে না আশা করি। এদিকে ডাবলিনে টিউব লাইন (ডার্ট টু) বসানোর কাজও এগিয়ে চলেছে জোরেশোরে। সেই ট্রেনও যাবে নুতন বাসার কাছ দিয়ে। তাই আর দেরী না করে ডিপোজিট জমা দিয়ে বাসাটা নিয়ে নেই। আগামীকাল সেই বাসায় উঠবো। দেখা যাক নুতন বাসা নুতন ভাগ্য নিয়ে আসে কিনা।

আজ ঘুম থেকে উঠতে অনেক দেরী করেছি। প্রায় দুইটার দিকে উঠে শাওয়ার নিয়ে খেতে গিয়েছি। কিন্তু বাসায় কিছু ছিলনা। থাকার কথাও না। আমি গতকিছু দিন খাবার কেনা বন্ধ করে দিয়েছি। ফ্রিজ খালি করার প্রক্রিয়া চলছে যাতে নুতন বাসায় যাবার সময় ঝামেলা কাঁধে করে না নেয়া লাগে। ভেড়ার কলিজা কিনেছিলাম দুদিন আগে। সেটাই রান্না করতে দিলাম। তারপর পরোটা আর ডিম অমলেট করে প্যানের পাশে দাড়িয়ে রইলাম। কলিজা আর রান্না হয় না। এদিকে ক্ষিদায় পেট চো চো করছে; সাড়ে তিনটার বেশি বাজে তখন। শেষ পর্যন্ত অর্ধ-রান্না কলিজা নিয়ে খেতে বসলাম। মুখে দেই আর কাচা কলিজার গন্ধ পাই। অথচ আমি কিন্তু ফেলে দেই নাই। সেই গন্ধ সহ বসে বসে গপাগপ খেলাম। আজ বুঝলাম সুকান্ত এমনি এমনি লিখেনি, “ক্ষুধার রাজ্যে পূণিমার চাঁদ যেন ঝলসানো রুটি।”

খাওয়া দাওয়া শেষ করে গেলাম সিটি সেন্টারে খেলা দেখতে। বার্সিলোনা বনাম চেলসীর সেমিফাইনাল খেলা ছিল। সুপারম্যাক রেস্টুরেন্টে বসে খেলা দেখার সময় সৈকত ভাইয়ার ফোন পেলাম। নদী সহ ভাইয়া সিনেওয়ার্ল্ডে এসেছেন এক্স ম্যান দেখতে। যদিও এক্স ম্যান আগামীকাল মুক্তি দেয়া হবে, তবে আজ রাতে প্রিভিউ শো হবে। রাত সাড়ে দশটা থেকে তিনটা স্ক্রিনে চলবে এক্স ম্যান। আমাকে বললেন ওনাদের সাথে ছবি দেখতে যেতে। সাথে নাফিসও খেলা দেখছিল। ওকে নিয়ে খেলা শেষে পৌনে দশটার দিকে চলে গেলাম সিনেওয়ার্ল্ডে। সেখানে সাড়ে বারোটা পর্যন্ত এক্স ম্যান দেখে রাত প্রায় একটার দিকে আমাকে নামিয়ে দিয়ে গেলেন বাসায়। তারপর একটু মেইল চেক করলাম, ফেইসবুকেও খানিক্ষন ঘোরাঘোরী করলাম। অতঃপর এলাম ব্লগে।

রাত তিনটার বেশি বাজে এখন। বুঝতে পারছি ঘুমানো দরকার। আগামী কাল অনেক কাজ জমে আছে। রেস্ট না নিলে সমস্যা হবে। কিন্তু ঘুম যেন আজ আর আসছে না। মাঝে মাঝে নিজেকে দেখে অবাক হই। এক জীবনে আমার সবচেয়ে আচেনা লাগে এই আমাকে। আমি যেন আমায় প্রতিদিন নুতন করে চিনছি। হয়তো আজ যে আমি লিখছি, কাল আর ‘সে’ থাকবো না। এভাবেই বোধয় জীবন বয়ে নেয় আমাদের; চলার মাঝেই যার সার্থকতা।

২৯ এপ্রিল ২০০৯
ডাবলিন, আয়ারল্যান্ড।
ডাবলিনের ডায়েরী – ১৪ (২৯ এপ্রিল ২০০৯)

এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান