ট্রেইটর – ২০০৮ সনের এক টানটান সাসপেন্স থ্রিলার


ট্রেইটর ২০০৮ সনে রিলিজ হওয়া হলিউড এ্যাকশন মুভি। ডন চিডল অভিনিত এই মুভির মূল ঘটনা একজন ধর্মভক্ত মুসলিম তরুনকে নিয়ে আবর্তিত হয়। মূলত আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদ এবং তার সাথে ইসলামের সম্পর্কের দিকটা নিয়েই ছবির কাহিনী। যাদের বডি অব লাইজ ভালো লেগেছিল, নিঃসন্দেহে ট্রেইটরও তাদের মনকে জয় করে নেবে।

এ ছবির সূচনা হয় পবিত্র কোরআনের পাতার উপর ক্লোজআপ ভিউ দিয়ে। সত্তুরের দশকে সুদানে ধার্মীক মুসলিম বাবার তত্ত্বাবধানে বেড়ে ওঠা এক বালকের জীবনের দিনগুলো দেখানো হয় সেখানে। তবে আপাত সুখি এই সময় বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। একদিন সেই বালক তার বাবাকে চোখের সামনে গাড়ি বোমা বিস্ফরনে মৃত্যুবরন করতে দেখে। তারপর কেবল বদলে যাওয়া। দেখতে দেখতে সময় কেটে যায় এবং আজকের পৃথিবীতে সেই ছোট বালক পরিনত হয় যুবক সামির হর্ন-এ।

সামির বড় হয়ে অস্ত্রের ব্যবসাকে পেশা হিসেবে গ্রহন করে। বিভিন্ন সংস্থাকে সে অস্ত্র সরবরাহ করতো। সেই সূত্র ধরেই সে একদিন যায় ইয়েমেনের প্রখ্যাত টেররিস্ট ওমরের কাছে। কিন্তু ঠিক সেই মূহুর্তে ইয়েমেনীয় গোয়েন্দা সংস্থা এবং এফ বি আই -এর যৌথ অভিযানে ওমর সহ নিহত হয় আরো অনেকে এবং সামির নিজেও গ্রেফ্তার হয় তাদের হাতে। বন্দি সামিরকে এফ বি আই এ্যাজেন্ট রয় ক্লেটন তথ্য দিয়ে সাহায্য করতে বললে সামির তথ্য সরবরাহ করতে অস্বীকৃতি জানায়। তখন এফ বি আই এ্যাজেন্ট সামিরকে মনে করিয়ে দেয় যে সে সন্ত্রাসীদের অস্ত্র সরবরাহ করে প্রকারন্তরে সন্ত্রাসেরই মদদ দিচ্ছে। সামিরও পাল্টা জবাব দেয় যে তার এবং যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে আসলে নীতিগত কোন পার্থক্য নেই। যুক্তরাষ্ট্রও অস্ত্র বিক্রি করে এবং বিক্রি করার সময় এটা বিবেচ্য বিষয় থাকে না যে কে কার উপর কখন সেই অস্ত্র প্রয়োগ করছে। ফলে এক সময় অবস্থা এমন দাড়ায় যে একগুয়ে সামিরের কাছ থেকে কোন রকম তথ্য বের না করেই ফিরে যেতে বাধ্য হয় এফ বি আই এ্যাজেন্টরা এবং সামিরকে প্রেরন করা হয় কারাগারে।

ইয়েমেনের কারাগারে বন্দী অবন্থায় সামিরের ধর্মীয় বিশ্বাস এবং সহমর্মিতা দেখে মুগ্ধ হয় আরেক সন্ত্রাসী ওমর। পরবর্তিতে ওমরের সহায়তায় সামির পালিয়ে যেতে সক্ষম হয় ফ্রান্সে। ওমর প্রকৃতপক্ষেই সামিরকে বন্ধু হিসেবে দেখেছিল এবং তাকে দুটো রাস্তা দিয়েছিল – সন্ত্রাসবাদে জড়ানো এবং সন্ত্রাসবাদে না জড়ানো। সামির প্রথম রাস্তাটা গ্রহন করে।

ধীরেধীরে লন্ডন থেকে পরিচালিত এক সন্ত্রাসী গং-এর একনিষ্ঠ কর্মী হয়ে উঠে সামির। ফরিদ এবং নাসির নামের দুই রাঘব বোয়ালের তত্ত্বাবধানে পরিচালিত এই দলটির মূল কাজ ছিল আত্মঘাতী বোমা হামলা করা। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে থাকা নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে তারা বিশ্বব্যাপি পরিচালনা করে তাদের সন্ত্রাসী কর্মকান্ড। একই সাথে তারা মুসলিম তরুন সমাজের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপের বিষয়ে ক্ষোভ তৈরী করার চেষ্টাও অব্যাহত রাখে যা পরবর্তিতে তাদের অত্মঘাতী হামলাকারী পেতে সাহায্য করছিল। এদিকে বোমা বিস্ফরন সংক্রান্ত প্রকৌশলে অসাধারন দক্ষ সামির তাদের জন্য হয়ে এসেছিল আশির্বাদ স্বরুপ। আত্মঘাতী বোমা হামলাকে সে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছিল এক অন্য উচ্চতায়। রিমোর্টকন্ট্রোল ট্রিগার ব্যবহার করে সামির নিজেও অংশ নিতে শুরু করে বোমা হামলায়।

ছবির এক পর্যায়ে দেখা যায় স্পেনের এক ট্যুরিস্ট স্পটে মার্কিন নাগরীকদের লক্ষ্য করে বোমা হামলা করা হয়। পরবর্তিতে হামলাকারীকে ধরা হলে তার থেকে এক চাঞ্চল্যকর তথ্য অবিষ্কার করে এফ বি আই এজেন্ট রয় ক্লেটন। সেই হামলাকারীকে যুক্তরাষ্ট্র স্টুডেন্ট ভিসা না দেয়ায় সে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি ধংসাত্বক হয়ে ওঠে এবং সন্ত্রাসীরা তার সেই অনুভুতির সুযোগ গ্রহন করে তাকে ব্যবহার করে। বিষয়টা দ্রুত এফ বি আই তাদের বিশেষজ্ঞ আলোচনা সভায় উপস্থাপন করে এবং খোঁজ নিয়ে দেখতে পায় মুসলিমরা নানা ভাবে বৈষম্যের শিকার হচ্ছে। একজনকে চাকরী থেকে বরখাস্ত করা হয়েছিল অথচ তার বিপক্ষে কোন সুস্পষ্ট অভিযোগ ছিলনা। এফ বি আই যখন অফিসের বসকে জেরা করে তখন বের হয়ে আসে বিস্ময়কর তথ্য। সেই বরখাস্ত অফিসারের দোষ ছিল সে নামায পড়তো যেটা ক্লায়েন্টদের চোখে দৃষ্টিকটু লাগতো। সেকুলার দেশে ধর্ম যেখানে নিতান্তই ব্যাক্তিগত বিষয়, সেখানে ধর্মের কারনেই বৈষম্যের শিকার হচ্ছিল মুসলিমরা আর সন্ত্রাসী সংঘগুলো পাচ্ছিল হামলাকারী।

এদিকে ফ্রান্সে অবস্থিত এক মার্কিন অফিসে সফল হামলার পর সামিরকে দেয়া হয় সবচেয়ে বড় হামলার দায়িত্ব – যুক্তরাষ্ট্রে একযোগে পঞ্চাশটা বাসে বোমা হামলা। ব্রিটিশ গোয়েন্দা সংস্থা এম আই ফাইভের এজেন্টরা এই তথ্য বের করতে পারলেও কবে এবং কখন হামলা করা হবে সেটা বের করতে ব্যার্থ হয়। এফ বি আই এবং এম আই ফাইভ যখন সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে, তখন ক্যানাডা এবং ম্যাক্সিকোর বর্ডার দিয়ে সামির এবং ওমর প্রবেশ করে যুক্তরাষ্ট্রে। একদিকে গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর চোখে ধুলা দিয়ে একেরপর এক বোমা হস্থান্তর করে যায় সমির বিভিন্ন হামলাকারীদের কাছে, অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র সামিরের নাম সন্ত্রাসীদের মোস্ট ওয়ান্টেড লিস্টে প্রকাশ করে তাকে যেকোন উপায়ে ধরিয়ে দেয়ার আহবান জানায়। ঘটনায় যখন টানটান উত্তেজনা তখন আসে সেই চূড়ান্তক্ষন – একযোগে হামলার দিন। ঘটনা অনেক বলে ফেললাম? আসলে না। সাসপেন্সগুলো লুকিয়ে ট্রেলারের মত করে লিখলাম। বাকিটা জানতে হলে দেখতে হবে ছবিটা!

ট্রেইটরের কে আসল ট্রেইটর সেটা একটা বড় প্রশ্ন। সামিরের মা রয় ক্লেটনকে বলেছিল, “আমার ছেলে অনেক রক্ত দেখেছে। সে জানে কোনটা ঠিক, কোনটা ভুল।” ওমর তরুন মুসলিমদের বলতো, “সন্ত্রাসী শব্দটা আপেক্ষিক। ব্রিটিশদের কাছে আগে মার্কিনরা ছিল সন্ত্রাসী। অথচ ওরা নিজেরাই এখন ইতিহাস ভুলে গিয়েছে।” ফরিদ মদ খেতে খেতে এর যথার্থতা হিসেবে বলতো, “আল্লাহ বলেছেন শত্রুকে জানতে তার মত চিন্তা করতে।” আর সামির বলতো, “হাদিসে এসেছে, যদি তোমার মুসলিম পরিচয় গোপন রাখতে হয় তবে মৃত্যু সামনে এসেছে একমাত্র সেরকম সময়েই সেটা করো।”

একদিকে বৈষম্যের শিকার ধর্মভক্ত মুসলিম সমাজ, অন্য দিকে স্বার্থলোলুপ সন্ত্রাসী সংঘ – এই দুইয়ের মাঝে ক্রমাগত সন্ত্রাসী হামলার চাপে পিষ্ঠ পাশ্চাত্য বিশ্ব। স্টিভ মার্টিনের গল্পে তৈরী ট্রেইটর সন্ত্রাসের ভয়াবহতার পাশাপাশি দেখিয়েছে সন্ত্রাসের কারনও। ডন চিডলের অভিনয়ও হয়েছে দারুন ভাবে প্রশংসিত। শিকাগো সান-টাইমস লিখেছে: “The movie proceeds quickly, seems to know its subject matter, is fascinating in its portrait of the inner politics and structure of the terrorist group, and comes uncomfortably close to reality. But what holds it together is the Cheadle character.” IMDB-তে দর্শক ভোটে মুভিটা ১০ এর মাঝে ৭.২ স্কোর করেছে ১৩,৮৪১ জনের ভোটে। এক কথায় পরিচ্ছন্ন এবং দারুন সাসপেন্সে ভরপুর একটা হলিউড এ্যাকশন মুভি ট্রেইটর।


২৯ মার্চ ২০০৯
ডাবলিন, আয়ারল্যান্ড।
ট্রেইটর – ২০০৮ সনের এক টানটান সাসপেন্স থ্রিলার

এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান