ডাবলিনের ডায়েরী – ১২ (৪ মার্চ ২০০৯)


ডায়েরী লিখতে ইচ্ছে করে না এখন। কেন যেন ইচ্ছে গুলো দিনদিন মরে যাচ্ছে। আসলে ইচ্ছেরাতো তুচ্ছ; যেভাবে নির্বিচারে মানুষ মরে যেতে দেখলাম, তাতে নিজের বেঁচে থাকাটাও এখন অবাক করা বিষয় মনে হয়। গত কিছুদিনের বর্ননা যদি ডায়েরীতে তুলি, তাহলে সেটা বছর বিশেক পরে মানুষের কাছে রুপ কথা মনে হবে। আমাদের প্রজন্ম যেমন একাত্তরের ভয়াবহতাকে কেবল সেলুলয়েডের পর্দায় দেখে, তেমনই আগামী প্রজন্ম ২০০৯ এর ফেব্রুয়ারী মাসের গল্প বই-ডায়েরী থেকে পড়বে।

শুরুটা ছিল ২৫ ফেব্রুয়ারী তারিখে। ব্লগ এবং ফেইসবুকে বিচ্ছিন্ন সংবাদ শুনতে শুরু করলাম। ঠিক কি হয়েছে বুঝে উঠতে পারছিলাম না। এলোমেলো পোস্টগুলো থেকে যখন বুঝে ওঠার চেষ্টা করছি আসলে কি হয়েছে, তখন ফেইসবুকে এক বন্ধুর দেয়া বিস্তারিত পোস্টের মাধ্যমে খানিকটা অবগত হলাম। তবে ভয়াবহতার বিষয়টা সামান্যতমও আঁচ করতে পারিনি। বিডিআরদের দাবী তখন যৌক্তিকই মনে হয়েছিল। তাছাড়া বিডিআর অফিসারদের আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ হতে জীবনে কম দেখিনি। পুলিশ অফিসার বাবার কর্মসূত্রে এক সিলেট বাদে দেশের সব বিভাগে অন্তত একবার করে থাকার অভিজ্ঞতা রয়েছে আমার। চট্টগ্রাম (১৯৮২), পাবনা (১৯৮২-১৯৮৪), পটুয়াখালী (১৯৮৪-১৯৮৬), ঢাকা (১৯৮৬-১৯৯১), চাপাই নবাবগঞ্জ (১৯৯১), মাদারীপুর (১৯৯১-১৯৯৪), খুলনা (১৯৯৪-১৯৯৬), বরিশাল (১৯৯৬-১৯৯৮), রাজশাহী (১৯৯৮-১৯৯৯) এবং অতঃপর আবার ঢাকা (১৯৯৯-২০০৭)। তাছাড়া আমার গ্রামের বাড়ি সীমান্তবর্তি জেলা ফেনী হওয়াতে বিডিআরের কার্যকলাপ আরো বিশেষভাবে জানার ও দেখার সুযোগ হয়েছে। অতএব তাদের সাধু কোনদিনই আমি ভাবিনি। তাছাড়া এটাও জানার বাকি ছিলনা যে বিডিআরে সাধারনত (ঢালাও ভাবে নয় যদিও) সুপারসিটেড অফিসারদের পাঠিয়ে দেয়া হয়। অর্থাৎ যাদের আর প্রোমোশনের সম্ভাবনা নেই, তাদের দিয়ে দেয়া হয় বিডিআর-এ। অতএব সেই অফিসারগুলো দূর্নিতী করার সময় কোন বাছ-বিচারের ধার ধারে না আর। বিডিআর বিদ্রোহের প্রথম দিনে তাই জাওয়ানদের এই পদক্ষেপকে বিপ্লব বলেই মনে হচ্ছিল।

পরদিনের ঘটনা। ২৬ তারিখ আমার জন্য ছিল এক ব্যাস্ত দিন। গতকিছুদিন আমি মানসিক ভাবে সুস্থবোধ করছি না। তাই সাইকিয়াট্রিস্ট এর সাথে এ্যাপোয়েন্টমেন্ট নিয়েছিলাম বিকেল তিনটায়। যদিও এখন ডিসএ্যাবেল ডিপার্টমেন্টের টিএ-এর কাজটা প্রায় ছেড়েই দিয়েছি, তবুও এক ছাত্রকে আমার সপ্তাহে দুই ঘন্টা সময় দিতে হয়। ওর সাথে মিটিং ছিল দুইটায়। মোটামোটি ব্যাস্ত দিনের পরিকল্পনা সাজিয়ে যেই কম্পিউটারে বসলাম, দেখলাম পরিস্থিতি ঘোলাটে। কি হয়েছে বোঝা যাচ্ছে না। কি সব সাধারন ক্ষমা নিয়ে আলোচনা চলছে ব্লগে। সারারাত নাকি অফিসারদের পরিবার সহ সবাইকে আটকে রেখেছিল বিডিআর। লন্ডনে ফোন করে আমার কাজিন পাভেল ভাইয়া এবং ওর বন্ধুদের ঘুম ভাঙ্গালাম। বেশ কিছুসময় স্কাইপ দিয়ে ভয়েস কনফারেন্সও করলাম। কিন্তু সময় যত যেতে লাগলো ততই যেন অবস্থা খারাপ হতে শুরু করলো। ইতিমধ্যে বিডিআর প্রধানের মৃত্যু সংবাদ বাতাসে ভাসতে শুরু করেছে। ভাবলাম বাসায় ফোন করে আম্মু আর ছোটবোনের খোঁজ নেই। কিন্তু কেউ ফোন ধরলো না। টেনশন বেড়ে গেলো। এবার কল দিলাম আমার ছোটবোনের মোবাইল ফোনে। অন্তত পাঁচবার টানা রিং হয়ে কেটে গেলো কিন্তু কেউ ধরলো না। ব্যাপারটা কি? টেনশন তখন চরমে। আবার কল দিলাম। এবার ছোটবোন ধরলো:
– কি ব্যাপার? এতক্ষন ফোন ধরলে না কেন?
ছোটবোন ফিসফিস করে কথা বলছে তখন।
– ভাইয়া আমরা নূর মোহাম্মদ আঙ্কেলের (পুলিশের আইজি) বাসায়।
– কেন কি হয়েছে?
– ওনার মেয়ের হাসবেন্ড মারা গিয়েছে। ঐ যে গত ডিসেম্বরে যে আপুর বিয়ে হলো, ওনার হাসবেন্ড।
– কিভাবে?
আমি তখন রীতিমত বাকরুদ্ধ।
– তুমি কি পত্রপত্রিকা পড়ো না? বিডিআররা আর্মি আফিসারদে মেরে ফেলেছে।
– পড়েছি। কিন্তু সেটাতো কয়েকজন।
– পত্রিকায় সব ভুয়া খবর। ওরা কিছুই জানে না। এখানে আমি শুনতে পাচ্ছি ভেতরে যারা ছিল, সবাইকে ওরা মেরে ফেলেছে। অন্তত একশ ছয়জন অফিসারকে ওরা মেরে ফেলেছে। আপুর হাসবেন্ড ডিজির এডিসি – ক্যাপ্টেন তানভির। ওনাকে ডিজিকে মারার সময়ই মেরে ফেলেছে। আজকে লাশ হস্তান্তর করেছে। আইজি আঙ্কেল এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ভোরে গিয়ে আপুকে উদ্ধার করে নিয়ে এসেছে।
এমন সময় আম্মু ছোটবোনকে ফোন রাখতে বলে। বোন জানায় বাসায় গিয়ে বিস্তারিত জানাবে।

আমি হতবাক হয়ে তখন বসে আছি। আব্বুর চাকরী সূত্রে মৃত্যু আমার পরিবারকে খুব কাছ থেকে একাধিকবার ছোবল দিয়ে গিয়েছে। কিন্তু কোনদিন এরকম অসহায় বোধ করিনি। মনে পড়ে খুলনা থাকাকালিন আব্বুর গাড়ীতে সন্ত্রাসীরা বোমা মেরেছিল। দুপুর বেলা আমি আর আমার ছোটবোন বসে বসে জিটিভি দেখছিলাম। হঠাৎ দেখি আম্মু ফোন ধরে কাঁদছে আর বলছে (অন্য প্রান্তে ছিল কেএমপির তৎকালিন পুলিশ কমিশনার রহিম আঙ্কেল যিনি হাসপাতাল থেকে সংবাদটা আম্মুকে প্রথম দিচ্ছিলেন), “ভাই শুধু এটা বলেন, উনি কি বেঁচে আছেন?” আম্মুর বলা এই কথাটা সম্ভবত আমি আমৃত্যু আমার কানে শুনতে পাবো। অথচ সেদিনও আমি এতটা অসহায় বোধ করিনি, যতটা আমি এদিন করছিলাম।

আমার ছাত্রকে টেক্সট করে জানাই আমি আজকের মিটিং বাতিল করছি। সাইকিয়াট্রিস্টকেও মেইল করে এ্যাপোয়েন্টমেন্ট বাতিল করি। গত বিকেলে খেয়েছিলাম, এর পর আর কিছু খাওয়া হয়নি। দুপুর গড়িয়ে যাচ্ছে অথচ খাবার ইচ্ছে একটুও হচ্ছিল না। বারবার মনে পড়ছিল মাত্র ৮৮ দিনে বিধবা হওয়া মেয়েটার কথা। জেনারেল শাকিলের কথা। তার স্ত্রীর কথা। সম্পর্কে তিনি আমাদের আত্মিয়া ছিলেন। গুজব তখন তুঙ্গে যে তিনিও মারা গিয়েছেন। কি হচ্ছে এসব? এভাবে মানুষ মেরে ফেলা কি এতই সহজ? সেদিন আর বিশ্ববিদ্যালয় যাইনি। থেকে থেকে ব্লগ, প্রথম আলো পত্রিকা এবং অন্যান্য সংবাদ মাধ্যম থেকে খবর নিচ্ছিলাম। প্রথম আলো ব্লগের মুকুট ভাই তখন অনলাইনে বাংলা টিভি দেখার একটা চমৎকার লিঙ্ক দিয়েছিলেন। ওটা দিয়ে চ্যানেলগুলোর সংবাদও দেখার চেষ্টা করছিলাম।

খানিক পরে ছোটবোন গুগল টকে এসে জানালো খবর ভালো না। নৃশংসতা চলছে চরম পর্যায়ে। একেকটা খবর যেন লোমহর্শক হয়ে উঠছে ওদের কাছে। যেন বাস্তব নয়, সিনেমার গল্প। মাজহার ভাই ছিলেন আমার এক কাজিনের বন্ধু। ক্যাডেটে এক সাথে পড়েছে তারা। সেই ভাইয়াকে তিনি কল করে বলেছিলেন “ওরা আমাদের ঘিরে ফেলেছে…”। এরপর মাজহার ভাইকে আর আমার কাজিন ফোনে পায়নি। বন্ধুর বলা সেই শেষ কথাগুলো হয়তো আমার কাজিনকে আজীবন তাড়িয়ে বেড়াবে। আমাদের আরেক আত্মিয়র সাথে মিসেস শাকিলের কথা হয়েছিল, তখনও তিনি বেঁচে ছিলেন। তিনি আঙ্কিত ভাবে বারবার বলছিলেন, “ওরা আমাদের মেরে ফেলবে, ওরা আমাদের মেরে ফেলবে।”

সবচেয়ে বেশি অস্থির হয়ে ছিল আমার মেজ মামা। মিশন থেকে ফিরেছেন গত নভেম্বরে। এখন আর্মি হেডকোয়ার্টারে পোস্টিং। মামার খুব কাছের বন্ধু হায়দার আঙ্কেল যিনি বিডিআরের আনুষ্ঠানে অংশ নিতে গিয়েছিলেন পিলখানায়। তিনি সেখান থেকে মামাকে ফোন করেছিলেন। হায়দার আঙ্কেল জানান তিনি একটা টয়লেটে লুকিয়ে আছেন। চারদিকে চলছে নির্বিচারে হত্যা। পরে হায়দার অঙ্কেলের ফোনও ‘আন রিচেবল’ হয়ে যায়। মামা তার বন্ধুকে খুঁজে বেড়াচ্ছিলেন পাগলের মত।

এত কিছুর পরও, সেদিন কিন্তু আমি আশাবাদী ছিলাম। বারবার ভাবছিলাম আমার ছোটবোন যা বলছে তা হয়তো ভুল হবে। অন্তত এভাবে মানুষ মারা সম্ভব নয়। পনেরো হাজার জাওয়ানের মধ্যে কি কারো না কারো অফিসারদের প্রতি টান ছিল না? তারা কি উশৃঙ্খল জাওয়ানদের যা ইচ্ছে করতে দেবে? কিন্তু হায়! আমি কত বড় ভুল ছিলাম। যেখানে শয়তান ঢোকে, সেখানে সাধুও বুঝি উল্টা রথে ওড়ে। পরদিন ফেইসবুকে আমার এক বন্ধ, অহনা, ম্যাসেজ পাঠায়। অহনার ভাইও মাজহার ভাইয়ের বন্ধু। তিনি দেখেছেন মাজহার ভাইয়ের এক চোখ এবং মাথার এক অংশ ছিলনা। মানুষ কতটা নিষ্ঠুর হতে পারলে এভাবে হত্যা করে সেটাই ভাবছিলাম। এ কি আমার প্রিয় বাংলাদেশ? এ কি আমারই নিজের মানুষ? ভাইয়ের রক্তে আজ ভাই হোলি খেলছে!

আর্মির তিব্র আক্রমনাত্মক রুপ দেখেই হোক বা অন্য কোন কারনে, বিডিআরের তথাতথিত বিদ্রোহ যখন শেষ হয়ে গেলো, আসল মাতম শুরু হলো তখন। আমার ছোটবোনের বলা কথাটা চরম সত্য হয়ে ফুটে উঠতে লাগলো। একে একে প্রকাশিত হলো গনকবরগুলো। নির্মম-নিষ্ঠুর ভাবে হত্যা করা হয়েছে একেকজন অফিসারকে। পাগলের মত পিলখানা খুঁজে খুঁজে মামা বের করেছিলেন হায়দার আঙ্কেলকেও। তবে সেটা শরীরমাত্র। লুটপাট করে কিছু নেয়ার বাকি রাখেনি কোন বাসায়। এক বাসার এলোমেলো ধ্বংশস্তুপের মধ্যে পড়ে থাকতে দেখলাম এক হতভাগা মহিলার লাশ। কি অদ্ভুত। এ গল্প আম্মুর কাছে শুনেছিলাম। একাত্তরের গল্প। ব্লাড বার্থ অব বাংলাদেশ বইটাতে ছবিগুলো দেখেছিলাম। এক সাথে অনেক মানুষ মেরে ফেলে রাখার। ২০০৯ সনে স্বাধীন দেশের বুকেও আজ একই চিত্র দেখলাম। পার্থক্য তবে কোথায় রইলো?

ছোটবোন জানালো এক রিটেয়ার্ড কর্নেল এসেছিলেন জেনারেল শাকিলের বাসায়। তার স্ত্রী ছিলেন প্রেগনেন্ট। কর্নেলকেতো হত্যা করেছেই, সাথে তার স্ত্রীকে এমন ভাবে হত্যা করেছে যে তার আনবর্ন বেবী বের হয়ে এসেছিল পেট থেকে। সত্যি বলতে কি, সেদিন প্রথমবারের মত আমি লজ্জাবোধ করেছি যে আমি বাংলাদেশের নাগরিক। যে মানুষগুলোকে মেরে ফেলা হলো, তাদের সামনে কি আমরা কোনদিন গর্বিত ভাবে দাড়াতে পারবো? ক্যাপ্টেন তানভিরের স্ত্রী ফটো নিয়ে কাঁদছিলেন আর সবাইকে জিজ্ঞেস করছিলেন কেউ মানুষটাকে দেখেছে কি না। সেই ছবিতে তাদের মাঝে একটা ফুটফুটে শিশু ছিল। এই শিশু বড় হয়ে যদি প্রশ্ন করে, আমরা কি কোন জবাব দিতে পারবো?

যদিও এই প্রশ্নগুলো অনেকেই ভাবেনি। এরকম সময়েও কেউ কেউ হত্যাকান্ডের সমর্থনে যুক্তি দেখানোর চেষ্টা করেছেন আমার ব্লগ পোস্টগুলোতে। একটা বারও তারা ভাবেননি আর্মি অফিসাররা ক্লোন্ড মানব নয়। তাদেরও পরিবার আছে। তাদের বাবা-মাও হয়তো আমাদের মতই সাধারন মানুষ। তাদের সন্তানরা বা স্ত্রীরা আপনার আমার মতই সিভিলিয়ান। তাদের কাছে আর্মি মানে পশুর থেকেও নীচ কিছু। অনেকের উল্লাস দেখে মনে হয়েছে এভাবে আর্মি অফিসারদের মৃত্যু যেন যারপর নাই আনন্দের বিষয়। যাইহোক, প্রথম কয়েকদিন খুব অবাক লাগছিল। কিন্তু কয়েকদিন পর মোটামোটি একটা উত্তর আমি খুঁজে পাই। তারপর কেবল হেসেছিলাম। তাচ্ছিল্যের হাসি। এখন আমি খানিকটা বুঝতে পারি আর্মি অফিসাররা কেন ‘ব্লাডি সিভিলিয়ান’ শব্দটা বলে!

ডায়েরী আর বড় করবো না। আসলে এসব লিখে কোন লাভও নেই। জীবনটা খুব অদ্ভুত হয়ে যাচ্ছে দিন দিন। কেমন যেন এলোমেলো। গোছানোর চেষ্টা করছি প্রানপণ। কিন্তু সবকিছু চাইলেই কি আর করা যায়? কিছুকিছু বাস্তবতা আমাদের হাতের নাগালের অনেক দূরে থাকে। তখন কেবল চেয়েই থাকতে হয়। যেন পাথর সময় বুকে নিয়ে অপেক্ষা করা। আমিও হয়তো তাই করছি। কিন্তু কিসের জন্য অপেক্ষা – সেটাই শুধু বুঝি না।

৪ মার্চ ২০০৯
ডাবলিন, আয়ারল্যান্ড।
ডাবলিনের ডায়েরী – ১২ (৪ মার্চ ২০০৯)

এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান