ডাবলিনের ডায়েরী – নয় (১৬ অগাস্ট ২০০৮)


গত দুদিন রীতিমত হুটহাট করে বেশ কিছু ঘটনা ঘটে গেলো। অনেকটা মিরাকলের মতই মনে হচ্ছে, যেন হঠাৎ শুন্য থেকে হাতের মুঠোয় একটা বেড়ানোর সুবর্ন-সুযোগ চলে এসেছে। ভণিতা না করে খুলেই বলছি। পরশু বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে মেইল চেক করে দেখি আমাদের ইন্টারনাল চেইনে একটা ওয়ার্কশপ কাম সামার স্কুলের ইনভাইটেশন এসেছে, নর্দার্ন আয়ারল্যান্ডের অলস্টার বিশ্ববিদ্যালয় (ডেরী ক্যাম্পাস) থেকে। প্রথমে খুব একটা গুরুত্ব দেইনি; এরকম বহু আমন্ত্রন প্রতিদিনই আসে। অতএব এটাকে বিশেষ ভাবে দেখার তেমন কোন কারন নেই। কিন্তু মেইলটা দৃষ্টি আকর্ষন করতে বাধ্য হলো সাবজেক্টের কারনে। সেখানে লেখা আছে খুব অল্প কিছু ছাত্রদের জন্য রেজিস্ট্রেশন ফিস মউকুফ করা হবে। আসন যেহেতু সীমিত, যারা আগে আবেদন করবে তারাই সুযোগ পাবে। দ্রুত যোগাযোগের ঠিকানায় চোখ বুলিয়ে নিলাম এবং প্রথম ধাক্কাটা তখনই খেলাম। জনৈক ড. এন এইচ সিদ্দিকী’র সাথে যোগাযোগ করতে বলা হয়েছে। এই নামটা আমার খুব পরিচিত লাগলো। মনে করার চেষ্টা করলাম নামটা আমি কোথায় দেখেছি। পুরোপুরি মনে না পড়লেও অনুমান করতে সক্ষম হলাম। আমি যখন রিপাবলিক অব আয়ারল্যান্ড (এই পোস্টে পরবর্তিতে এই নামটাকে সংক্ষেপে রিপাবলিক লেখা হবে) আসি তখন নর্দার্ন আয়ারল্যান্ড থেকে একজন স্যার আমাকে মেইল করে কনগ্রাচুলেট করেছিলেন। বলাইবাহুল্য তিনি বাংলাদেশী। আমিও কৃতজ্ঞতা জানিয়ে পাল্টা মেইল করেছিলাম। তবে এরপর আর যোগাযোগ হয়নি। আমার কেন যেন মনে হচ্ছিল তিনিই ড. এন এইচ সিদ্দিকী। জিমেইলের আর্কাইভ মেইলে সার্চ দেয়ার সাথে সাথে বিষয়টা পরিষ্কার হয়ে গেলো; আমার অনুমান শতভাগ সঠিক। চিন্তাটা তখনই মাথায় আসলো। একবার নর্দার্ন আয়ারল্যান্ড থেকে ঘুরে আসলে কেমন হয়? রিপাবলিকের আইরিশদেরতো গত নয় মাস দেখলাম, এবার একটু পাশের দেশের আইরিশদের দেখে আসলে মন্দ হয় না।

যেমন ভাবা তেমন কাজ – দ্রুত স্যারকে মেইল করলাম। জানালাম আমি অংশগ্রহনে আগ্রহী। স্যারও প্রায় সাথে সাথে আমাকে পাল্টা মেইল করে জানালেন কোন সমস্যা নেই। খুবই সীমিত কিছু ফ্রি রেজিস্ট্রেশন তাঁরা দেবেন যার ভেতরে আমারটা গ্যারান্টেড! যদিও তাদের দেশের কুইনস ইউনিভার্সিটি অব বেলফার্স্ট এবং রিপাবলিকের ইউ. সি. ডি এবং অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইতিমধ্যে বেশ কিছু অনুরোধ চলে এসেছে তবে সেগুলোর সবার উপরে আমার প্রায়োরিটি কারন আমি বাংলাদেশি এবং এই ইভেন্ট অয়োজনের মূলভার স্যারের উপরে। অতএব আমি পরে আবেদন করেও ২৫০ পাউন্ডের রেজিস্ট্রেশন উয়েভার পেয়ে গেলাম।

অবধারিত ভাবে এর পর আলোচনার বিষয়ে এলো ভিসা। যেহেতু নর্দার্ন আয়ারল্যান্ড যুক্তরাজ্যের একটা সাংবিধানিক রাষ্ট্র, অতএব এখানে প্রবেশ করতে হলে আমাকে ব্রিটিশ ভিসা নিতে হবে। দ্রুত গুগলে সার্চ দিলাম আরো পরিষ্কার হবার জন্য এবং বিস্মিত হয়ে জানতে পারলাম বিভিন্ন পরষ্পর বিরোধী তথ্য। রিপাবলিক অব আয়ারল্যান্ড এবং নর্দার্ন আয়ারল্যান্ডের মাঝে যে বর্ডার রয়েছে (বিস্তারিত) সেটায় কোন কাস্টমস, ইমিগ্রেশন অথবা পাসপোর্ট কন্ট্রোল নেই। যদিও আকাশ এবং পানি পথে রিপাবলিক থেকে নর্দার্নে গেলে ভিসা স্ট্যাম্পিং করাতে হয় কিন্তু স্থল যাত্রা পথে কিছুই করতে হয়না। একটা ফোরামে এক ছেলে এভাবে লিখেছে যে যদি ওদিক থেকে এদিকে আসতে চাও তবে বাসে, ট্রেনে, সাইকেলে, ঘোড়ার পিঠে, কুকুরে টানা গাড়িতে বা হেটে আসো – কোন পাসপোর্ট কন্ট্রোল নেই। কিন্তু প্লেনে বা ফেরীতে আসলেই তারা ঘ্যান ঘ্যান শুরু করবে। কি করবো বুঝতে পারছিলাম না। তাই স্যারকে মেইল করে মতামত জানতে চাইলাম। স্যার আমাকে তার ফোন নাম্বার দিয়ে বললেন কল দিতে। যেহেতু মোবাইল থেকে করলে অনেক খরচ পড়ে, তাই আমি দ্রুত বাসায় এসে ভিওআইপি দিয়ে স্যারকে ফোন দিলাম। স্যার জানালেন ওদিক থেকে এদিকে অথবা এদিক থেকে ওদিকে নিয়মিত স্থল পথে যাওয়া আসা করে মানুষ। তবে ইদানিং থাকার মতলবে কিছু এশিয়ান নর্দার্নে ঢুকে আর রিপাবলিকে ফেরত যাচ্ছে না যেটা ব্রিটিশ সরকারকে চিন্তিত করে তুলেছে। এ জন্য মাঝে মাঝে বাসে পুলিশ দিয়ে চেক করানো হচ্ছে। তবে ট্রেনে এই সমস্যাটা নেই তাই স্যার ট্রেনে করে যাওয়ার জন্য পরামর্শ দিলেন। সাথে কাগজপত্রও রাখতে বললেন যাতে কোথাও চেক করা হলে যেন দেখাতে পারি যে আমি এখানকার ছাত্র এবং একটা ইভেন্টে অংশগ্রহনের জন্য নর্দার্নে ঢুকেছি। সত্য কথা বলতে কি, তবুও একটা ভয় মনের মাঝে রয়েই গেলো। আসলে ইমিগ্রেশনের লোক দেখলেই আমার কেমন যেন অসস্থি লাগে; যদিও দুই আয়ারল্যান্ডের মাঝে ইমিগ্রেশন শব্দটারই অস্তিত্ব নেই!

সবকিছু গুছিয়ে এনে কাল আমার সুপারভাইজারের সাথে দেখা করলাম বিষয়টা নিয়ে কথা বলতে। প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত মন দিয়ে শুনলেন স্টিফান, তারপর বললেন যেহেতু রেজিস্ট্রেশনের কোন ঝামেলা নেই, অতএব আমার যাওয়ার ব্যপারে তার কোন আপত্তি নেই। ধন্যবাদ দিয়ে বের হয়ে আসার সময় স্টিফান ডেকে বললেন আমি যেন যাওয়া-আসা, থাকা-খাওয়া এবং আর যা যা খরচ হয় সব ভাউচার রেখে দেই। সেটা পরে আমি ক্লেইম করে তুলে নিতে পারবো। এই বেলায় আমার মনে পড়লো অতিরিক্ত ৮,০০০ ইউরোর কথা যেটা আমাকে স্কলারশীপের সাথে দেয়া হয়েছিল। প্রায় হাজার ইউরো দিয়ে কম্পিউটার আর দুই দফা অপনেটের লাইসেঞ্জ কেনা ছাড়া বাকিটা সব একাউন্টেই পড়ে আছে। আমি এটা নিয়ে কোন দিন কথাও তুলিনি। আগামী অক্টোবরে এটা ফিরিয়ে দিতে হবে যদি খরচ করে শেষ করতে না পারি। স্টিফান তাই আবারও মনে করিয়ে দিলেন, যদি এক বোতল পানিও কিনি, সেটার রিসিট যেনো সংগ্রহ করি এবং সব কিছুতে নিয়মের মধ্যে থেকে যেনো সর্বোচ্চ খরচ করে ফিরি!

স্টিফানের রুম থেকে যখন আমি বের হলাম তখন প্রায় সপ্তম আকাশে আমার পা। আগের দিন ওয়েব থেকে ট্রেনের টিকেটের দাম দেখছিলাম, বেছে বেছে সবচেয়ে কম দামী ক্যাটাগরির – রিপাবলিকের রাজধানী ডাবলিন থেকে নর্দার্ন আয়ারল্যান্ডের রাজধানী বেলফাস্ট পর্যন্ত ১৯ ইউরো। আজ আবার নিজের ডেস্কে ফিরে এসে দাম দেখলাম। সবচেয়ে দামী ক্যাটাগরি, প্রিমিয়ারের। ৪৯ ইউরো। ব্যাপার না। এখন আমার কাছে দাম কোন বিষয়ই না! স্টিফানের গ্রিন সিগনাল সব কিছু বদলে দিয়েছে। কি আছে জীবনে, একটু না হয় পশ ভাবেই ভ্রমনটা করলাম।

আজ সারাদিন টুকটাক কেনাকাটা করলাম। একটা বড় টুরিস্ট ব্যাগ কিনেছি। ওটা কাধে ঝোলানোর পর নিজেকে ইবনে বতুতার ছোট ভাই মনে হচ্ছিল। ইশ যদি জীবনটা এমনই হতো। দেশ থেকে দেশান্তরে ঘুরে বেড়াতে পারতাম। আমার ঘুরতে খুব ভালো লাগে – ইতিমধ্যে এশিয়ার বেশ কিছু এলাকা ঘোরা হয়েছে তবে ইউরোপে নিতান্তই নব্য পর্যটক। আয়ারল্যান্ড (রিপাবলিক) আর ইংল্যান্ড ছাড়া আর কোন দেশের বাতাসের গন্ধ পর্যন্ত নেয়া হয়নি। তবে এবার হবে ইনশাআল্লাহ। নর্দার্ন দিয়ে শুরু করি, এর পর একে একে ঘোরার পালা আসবে স্কটল্যান্ড, ওয়েলস, ফ্রান্স, ইটালী, সুইডেন, জার্মানী এবং সুইজারল্যান্ড। আপাতত এটা হিট লিস্ট। দেখা যাক কয়টা দেশ ঘোরার সৌভাগ্য ঈশ্বর কপালে রেখেছেন।

গোছানোর কাজ এখনো শুরু করিনি। কাল পুরো দিনটাইতো হাতে আছে। তাছাড়া আমি সব সময় এগারতম ঘন্টায় গোছানোর মানুষ। এখানে আসার আগের দিন রাতে আম্মু অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করেছিল আমার ফ্লাইট ভোরে অথচ আমি কেন কিছুই গোছাইনি। আমি হেসে বলেছিলাম ভোরে ফ্লাইট, অতএব ভোরেই স্যুটকেস গোছাবো! জানি এবারও তাই হবে আসলে। সোমবার নয়টা ত্রিশের ট্রেন ধরার চিন্তা করছি। বেলফাস্ট পর্যন্ত দুইঘন্টা দশ মিনিটের যাত্রা; এর পর বেলফাস্ট থেকে ডেরী যেতে কতক্ষন লাগবে সেটা ঠিক জানি না। স্টেশন থেকেই বাস ছাড়ে। সোজা বাসে চেপে বসার পরিকল্পনা। তারপর যা আছে কপালে দেখা যাবে।

এখানে গত কয়েক সপ্তাহ খুব বৃষ্টি হচ্ছে। রীতিমত ভাসিয়ে নিয়ে যাওয়া বৃষ্টি। সাথে তুমুল বাতাস। বাসা থেকে বের হওয়াটা অনেকটা অত্যাচারের পর্যায়ে পৌছে গিয়েছে। ছাতা ছিড়েছে, জুতারও দশা ছেড়ার কাছাকাছি। তার উপর হালকা বৃষ্টিতে ভিজলেই আমার জ্বরজ্বর করে। তবু্ও ভিজতে খুব ভালো লাগে। মনে মনে বলি, হোক না জ্বর কয়েকদিনের জন্য। তবুও এই যে ভেজার আনন্দ, এটাতো অন্য কিছুতে নেই। একটাই জীবন; সেটাও যদি ছাতার নিচে কাটিয়ে দেই তাহলে শারীরিক মৃত্ত্বুর আগেই হৃদয়ের ছোট ছোট আবেগগুলোর অপমৃত্ত্বু ঘটবে। আর আবেগ ছাড়া শরীর মৃত্ত্বুর থেকেও যন্ত্রনাময়। আর যাই করি না কেন, একটা কাজ আমি সব সময় করার চেষ্টা করি, জীবনের প্রতিটা মুহুর্তকে উপভোগ করা। মূহুর্তটা সুসময় নাকি দুঃসময়, সেটা আমার কাছে বিচার্য বিষয় নয়, উপভোগ করাটাই মূখ্য!

১৬ অগাস্ট ২০০৮
ডাবলিন, আয়ারল্যান্ড।
ডাবলিনের ডায়েরী – নয় (১৬ অগাস্ট ২০০৮)

এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান